রাজা | Raja | উপন্যাস | novel | golpo | bengali story

রাজা 
প্রথম পরিচ্ছেদ 

রাজা | Raja | উপন্যাস | novel | golpo | bengali story



  ধুলাউড়ি হাই স্কুল। সামনেই খেলাধুলার প্রশস্ত মাঠ। তারই এক পাশে মুড়িওয়ালা, ঘুগনিওয়ালাদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। আজ শুক্রবার - এক ঘন্টা টিফিন। সুতরাং ছাত্রগুলিও খেলার মাঠে নিশ্চিন্তে ফুটবল দখলের যুদ্ধে নেমে পড়েছে।

  ক্লাস এইটের কয়েকজন ছাত্রী স্কুলের একপাশে বসে আছে। দলটি থেকে মাঝেমধ্যেই হি-হি, হো-হো, খিঁ-খিঁ ইত্যাদি নানা প্রকার বৈচিত্র্যময় হাস্য তরঙ্গ ভেসে আসছিল।
- আমি তবে গল্পটা শুরু করছি; মানে আর কি কাহিনীটা বলছি। কিন্তু এর মধ্যে নো সাউন্ড, নো কমেন্ট, নো জ্বালাতন; তাহলেই কিন্তু গল্পের তাল কেটে যাবে। 
ডলি তার হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে গল্প শুরু করল - ওই যে সামনেই দেখতে পাচ্ছিস, মোটুরাম করুন দৃষ্টিতে এদিকেই তাকিয়ে আছেন। তিনিই কালকে আমাদের বাড়ি গেলেন দাদার সঙ্গে। মতলব খানা যে সুবিধের নয় সে আমি দেখেই বুঝলাম।.... অ্যাই সোমা ওর দিকে তাকিয়ে হাসিস না ও বুঝে ফেলবে।... অনুমান আমার মিথ্যা হলো না। দাদার বন্ধু সেজে গেলেন বটে, কিন্তু সুযোগ বুঝে একসময় থপ্ থপ্ করে চলে এলেন আমার কাছে। কথা হলো বিস্তর; সূচনাটাও করলেন বেশ ভালই। তারপরেই তার আসল চেহারাটা বেরিয়ে পড়ল। খপ্ করে আমার হাতখানা প্রায় ধরেই ফেলছিলেন আর কি! কোনক্রমে আমি তাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করলাম। এরপরেই তিনি যেন হঠাৎ ভেঙে পড়লেন; প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলেন - তুই আমাকে বাঁচা বোন। আমি যে পিয়াকে ছাড়া কিছুতেই বাঁচতে পারব না। তুই যে করেই হোক আমার সঙ্গে পিয়ার প্রেমটা লাগিয়ে দিস বোন। আমি তোর কাছে চিরজীবন ঋণী থাকবো রে.... বেচারী আরো অনেক কিছুই বলতে যাচ্ছিল। মনের গুপ্ত প্রেম প্রকাশের এমন সুযোগ তো আর হাতছাড়া করা যায় না! কিন্তু আমিই বা করি কি বল? নিজের প্রেস্টিজ বাঁচাতে হাঁদারামকে থামিয়ে দিলাম। বললাম- তুমি চিন্তা করো না নয়নদা। আমি থাকতে তোমার কোন ভয় নেই। পিয়াকে এমন পটকা পটকাবো যে ও তোমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে মরবে। আর তোমাকে কেই বা না চেনে বলো - তোমার গুণের কথা প্রতিটি মেয়েই জানে - এমন সরল, চরিত্রবান, মিশুকে ছেলে খুব কমই হয়।.....
  ব্যস্ আর বলতে হলো না। খুশির চোটে মোটুরাম তালজ্ঞান হারিয়ে ফেলল - ঝপাং করে আমার গায়েই ঝাঁপিয়ে পড়ছিল আর কি! আমি তো কোন মতে আত্মরক্ষা করলাম। আর ওদিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখ দুটি দিয়ে যেন পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। বার কয়েক হেঁ হেঁ করে হেসে উঠলো আর সঙ্গে সঙ্গে তার দুই গালের মাংসপিণ্ড গুলিও যেন ড্যান্স দিতে লাগলো। তারপরেই ফস্ ফস্ করে আওয়াজ বেরোলো - অ্যাই ডলি... হেঁ হেঁ.... সত্যি বলনা মাইরি .....হেঁ হেঁ... পিয়া আমার কথা কি কি বলে রে?
আমিও বেশ জম্পেশ করে..... এই দ্যাখ্ এসে গেছে।

 কে এসে গেছে দেখতে ফিরে তাকাতেই সবাই দেখতে পেল, রাকেশ বাইকে চেপে উড়ন্ত বাজপাখির মত এসে ঝপ করে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ এক কায়দা দেখিয়ে বাইক থেকে নেমে এলো। এই ছেলেটি এই স্কুলের ছাত্র নয়, কিন্তু মাঝে মাঝেই পিয়ার দর্শনার্থী হিসেবে বিভিন্ন অজুহাতে এই স্কুলে এসে থাকে। কোন ভূমিকা না করেই রাকেশ বলল - ওহ্ ডলি, সকাল থেকে বাইকে ঘুরতে ঘুরতে একেবারে টায়ার্ড হয়ে গেছি রে! যাকগে, এই খাতাটা তোর দাদাকে দিয়ে দিস। 
- আপনি তো নিজেই দিতে পারতেন!
- খুব জরুরী খাতা রে! তা না হলে কি আর আমি কষ্ট করে তোর কাছে আসি?

  কি জন্য কষ্ট করে আসা তা বুঝতে আর কারো বাকি রইল না।
- সকাল থেকে কোথায় গিয়েছিলেন রাকেশ দা?
- ওহ্, কত ঝামেলা রে! বাড়ির সমস্ত দায়িত্বই আমাকে সামলাতে হয় কিনা! এই দ্যাখ, যেমন বাবা বলবেন, এই নে এই মাসের সমস্ত মাইনে; যেমন করে পারিস সংসার চালাবি। তাছাড়া তো তুই জানিস বাবার একমাত্র ছেলে আমি; আমাকে দায়িত্ব দিয়ে উনি নিশ্চিন্তে বসে থাকবেন। আর সেখানেই তো আমার মরণ। তা না হলে কি আর সকাল থেকে ভূতের মত ছোটাছুটি করতে হয়? 
 
 এরই মাঝে সোমা বলে উঠলো, - চল পিয়া, আমরা জল খেয়ে আসি। ওরা গল্প করুক।
  এবার রাকেশ কৃত্রিম ব্যস্ততা দেখিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, - আমার বড্ড দেরি হয়ে গেল রে ডলি। আমাকে এক্ষুনি বহরমপুর যেতে হবে। ট্রেনটা বুঝি মিস করব।

 এবার পিয়ার দিকে তাকিয়ে বুকে সাহস বেঁধে মুখে কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল, - ভালো আছো পিয়া?
 মৃদুস্বরে পিয়া জবাব দিল - আছি। আপনি ভালো আছেন?

রাকেশ ঠিক কি জবাব দেবে তা সে যেন বুঝতেই পারল না। তার সামনে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে তাকে কথা বলছে স্বয়ং পিয়া..... যে পিয়ার জন্য কিনা আশপাশের চ্যাংড়া ছোকরার দল হা পিত্যেশ করে মরে। যার মায়াবী দুটি চোখ, ভুবন ভোলানো হাসি, হীরার মত উজ্জ্বল ত্বক, ফুলের মত মিষ্টি মুখমণ্ডল আর ঘোর কৃষ্ণবর্ণ চিকচিকে তরঙ্গায়িত কেশরাজি কত যে ছেলের হৃদয়ে ঝড় বইয়ে দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। আজ সেই পিয়ার সামনে মুখোমুখি কথা বলতে পেরে তার শুধুই মনে হতে লাগলো যেন পৃথিবীর চরমতম সাফল্য এখন তার হাতের মুঠোয় এসে গেছে। হঠাৎ ধেয়ে আসা ঝড়ো-বৃষ্টি যেমন হাটের সমস্ত হাটুরে দলকে মুহূর্তে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে একটা চরম অনিয়মের সৃষ্টি করে; তেমনি রাকেশের মনের সমস্ত কথাগুলিও যেন মুহূর্তে বিক্ষিপ্ত হয়ে একটা চরম বোকামিতে পরিণত হলো‌। সে কোনো রকমে তোতলাতে তোতলাতে বলল, - ভালো ........ ভালো......... হ্যাঁ হ্যাঁ ভালো ......... হ্যাঁ তোমাদের জন্য তো ভালো থাকবোই। ভালো না থাকলে কি আর এত দূর ছুটে আসতে পারি! ..........

  ভালো থাকা নিয়ে আরো কতকগুলি মূল্যবান ব্যাখ্যা উপস্থিত শ্রোতৃ মণ্ডলীর মধ্যে বিতরণ করে দিল। কিন্তু পিয়ার এ সমস্ত দুর্মূল্য সম্পদ সংগ্রহের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। সে সেখান থেকে সোমার সঙ্গে চলে গেল। রাকেশও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ যেন আকাশ থেকে পড়ল।
- ওহ্ ট্রেনের কথা আমি ভুলেই গেছি রে! কি ভোলারে আমি! ছি! ছি! ছি!  - বলতে বলতেই যেন ডিগবাজি খেয়ে বাইকে চেপে সে ফুড়ুত করে উড়ে গেল।



দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ


  বিকেল বেলা। বাড়ির সামনের কুলগাছের নিচে ছেলেমেয়েদের হৈ হট্টগোল তখন তুঙ্গে। নিচ থেকে কুল গাছ লক্ষ্য করে অভ্রান্ত নিশানায় তীব্র গতিতে ছুটে আসছে ইট পাটকেল। বেচারি কুলগাছ! মারের চোটে তার সুমিষ্ট প্রসাদ আক্রমণকারীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। আর তা কুড়ানোর জন্য ছেলেমেয়েরা রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করে দিচ্ছে। পাশেই কয়েকজন কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে যারা বছর কয়েক আগেই প্রকাশ্যলোকে ঢিল মেরে কুল পাড়ার বয়স হারিয়েছে - তারাও মাঝে মাঝে এদিক ওদিক তাকিয়ে টপ্ করে দু'একটা কুল কুড়িয়ে নিয়েই সুবিন্যস্ত পরিচ্ছদের মধ্যে কোথায় যে চালান করে দিচ্ছে তার আর হদিশ পাওয়াই দুষ্কর।

 ক্যাঁচ্ করে ব্রেক কোষে একদল সাইকেল আরোহী চ্যাংড়া দেখা দিল। এরা প্রত্যহ বিকেলে দল বেঁধে নিয়মিত একবার এই দিকে দেখা দিয়ে যায়। আজ নতুন এক ঢেঙ্গা সাইজের তরুণ ছোকরা দলটিতে অবতীর্ণ হয়েছে। ছোকরা তার বাঁশ মার্কা একটি পা মাটিতে ঠেকিয়ে হ্যা হ্যা করে একটু দাঁত কেলিয়ে কুল গাছের নিচে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল - খুকি, আমাদের দুটো কুল দেবে?
  কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতই হোক কিংবা অবজ্ঞাবশতই হোক খুকিদের কাছ থেকে কোন জবাব এলো না। এবার সাইকেলের সিট ডিঙিয়ে বাঁশ মার্কা দ্বিতীয় পাটিও মাটি স্পর্শ করল।
 - কি দারুন সাইজের কুল রে বাবা! এই না হলো কুল! - বলতে বলতেই ছোকরা গাছতলা থেকে বেশ কয়েকটি কুল কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে এলো। উপস্থিত সঙ্গীদের মধ্যে তা বিলিয়ে দিয়ে হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে শিলা নামের এক কিশোরীর দিকে তাকিয়ে বলল - আহ্ কি টক্! 
  তারপর মুখ দিয়ে টট্ করে একপ্রকার শব্দ বের করে হঠাৎ তার এক চোখ বন্ধ করে ফেলল, অর্থাৎ এত টক তার চোখের পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব নয়। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে সে সাইকেলে চেপে বসলো। শিলা বেচারিও চোখমুখ লাল করে আগুন ঝরাতে লাগলো। তার কম্পিত ঠোঁট থেকে শুধু একটি ঝাঁঝালো আওয়াজ বেরিয়ে এলো - জে-র ্যা ।
 - ওহ্ হাউ সুইট! হেঁ - হেঁ - হেঁ - হেঁ কি মিষ্টি তোমার গালি.... বলতে বলতেই ছেলেটি সাইকেল চালাতে শুরু করল। সামনে সাইকেলের রডে আরেকজন বসেছিল, সে অনেকটা ধমকের সুরে বলে উঠলো - এই রে রে রে রে রে রে, চুপ! রকি চুপ!
 
  রকি কিন্তু চুপ করার বদলে অপর দুই সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে সগর্বে বীরত্বের হাসি হেসে বলতে শুরু করলো, - তোরা এসব ভীতু ছেলে নিয়ে ঘুরিস কেন বলতো? এ তো কোনদিন লাইন মারতে পারবেই না, মধ্যে থেকে তোদের জীবনেরও বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। আজ দেখলি তো, মাত্র একদিন এসেই আমি কিভাবে মালটাকে পটকে নিলাম!

  সাইকেলের সামনে থেকে আবার তীব্র প্রতিবাদ শোনা গেল --  গালি খেয়েও পেট ভরল না; উল্টে আবার পটকানোর স্বপ্ন দেখছিস? লজ্জা না থাকলে যা হয়! তোর সঙ্গে ঘুরে আমাদেরও যে কবে প্রেস্টিজ পাংচার হবে তার ঠিক নেই।
  -- ঐটাই তো বুঝলি নারে বোকা! মেয়েদের সম্পর্কে তো তোর কোন জ্ঞানই নেই! এই যে আজ আমি গালি খেলাম, তার মানে কেল্লা ফতে! সিনেমায় দেখিস না গাধা, প্রথমে গালি খাওয়া, থাপ্পড় খাওয়া, তারপরেই তো শুরু হয় প্রেমের আসল কাহিনী।
  -- সে তোর প্রেমের কাহিনী যেদিনই শুরু হোক না কেন; আপাতত পিয়াদের বাড়ির সামনে একদম চুপ করে থাকবি। একেবারে কথা বলবি না।
 -- না, কথা বলতে হবে না! চুপচাপ ঘুঘুর মত বসে থাক, একদিন পিয়া নিজেই এসে তোর পা দুটি জড়িয়ে ধরে প্রেম নিবেদন করে যাবে। গাধা কোথাকার! ওই জন্যই তো তোর জীবনে এখন পর্যন্ত কিসসু হলো না।...... ওই দেখ তোর পিয়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।...... দেখবি, তোর পিয়াকে কথা বলবো?

  এই দলটির মধ্যে অন্য দুজন একটা সাইকেলে চেপে এতক্ষণ নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল। তাদের মধ্যে একজন এবার তাকে সাবধান করে দিল - খবরদার রকি, এখানে বেশি বেয়াদবি করিস না।
  রকি কিন্তু তার কথায় কান না দিয়ে গলা ছেড়ে সামান্য একটু সুর চড়িয়ে গান ধরলো - আর কত রাত একা থাকবো... আর কত রাত একা থাকবো.....
 -- আর তো তোকে এই দিকে নিয়ে আসা যাবে না দেখছি!
 -- একা একা তো খুব এক বছর ধরে ঘুরলি, লাভটা কি করলি শুনি? বিকেল হলে তো কারো আর বাড়িতে মন টেঁকেনা; মাল দেখার জন্য খেপে উঠিস। আবার এখন দেখে মনে হচ্ছে যেন সব সাধু সন্ন্যাসী! ভাবছিস সাধুগিরি দেখালেই বুঝি পিয়া তোর উপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে? কাঁচকলাও পাবি না। ওর জন্য শুধু তোরা একা ঘুরিস না, তোদের মত আরো কতজন লাইন দিয়েছে তা লক্ষ্য করেছিস? কে কোন ফাঁকে ওকে নিয়ে চলে যাবে তখন বসে বসে কলা চুষিস। এবার আমার দিকে দেখ; তোরা ভাবছিস শিলা আমাকে গালি দিল বলেই সব শেষ হয়ে গেল? খেলতো সবে শুরু হলো। এবার দেখিস কি হয়! ফেরার পথে ও যদি আমার দিকে ঘুরে ঘুরে না তাকায় তো দেখিস।  এটা আমার চ্যালেঞ্জ থাকলো। আর এটাও তোরা দেখতে পাবি যে ও আমার জন্য গাছ তলাতেই দাঁড়িয়ে আছে।

  ফেরার পথে সবাই অবাক হয়ে দেখল সত্য সত্যই শিলা তাদের জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে - তবে গাছ তলাতে নয়, একেবারে রাস্তার উপরে। আরও অবাক হয়ে দেখতে পেল সে একা নয়, তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং তার পিসি - হাতে একখানা আধপোড়া চেলা কাঠ।

 পিসি চেলা কাঠ হাতে ঝাঁসির রানীর মত বিপুল বিক্রমে পথ অবরোধ করে দাঁড়ালেন। কাঠখানা বার কয়েক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চোখ পাকিয়ে সিংহীর মতো গর্জন করে উঠলেন, - কোন জানোয়ারে চোখ মেরেছিস রে?

 ছোকরাগুলো থতমতো খেয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে পরস্পরের চোখ চাওয়া চাওয়ি করতে শুরু করল। পিসি আরেকটু এগিয়ে এসে কাঠখানা একেবারে ওদের মুখের সামনে তুলে ধরলেন --  দেখেছিস, আগুন দেখেছিস; চোখ দুটো ফুটিয়ে একেবারে কানা করে দেব!
 রকি নিজেকে সামলে নিয়ে একটু গলা খাকারি দিয়ে প্রতিবাদ করল -- ভদ্রভাবে কথা বলুন। কে কাকে চোখ মেরেছে যে আপনি চোখ মারার কথা বলছেন?

 এবার পিসি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন -- ইতর; খানকির ছেলে, আমাকে ভদ্রতা শেখাতে এসেছিস? চিনিস আমাকে? পিটিয়ে যখন ছাল তুলে নেব তখন সব বেরিয়ে যাবে।

 প্রকৃতই ছেলেগুলো কেউ শিলার পিসিকে চিনতো না। পিসি তার সুমিষ্ট বাগ্মিতার জন্য এলাকায় সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন। কোনো প্রতিবেশী সহজে তার সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে সাহস পেত না। দৈবক্রমে কেউ কখনো তার সঙ্গে ঝামেলা করার সৌভাগ্য অর্জন করলে পিসি তার সাত পুরুষের বিনি পয়সায় পিন্ডি দিয়ে ছাড়তেন।
 সুতরাং হাতের নাগালের মধ্যে এত বড় অপরাধীদের পেয়ে তিনি সহজে আর হাতছাড়া করতে চাইলেন না। বাংলা ভাষার যেসব অলংকার সহযোগে তিনি ছোকরাগুলোর চৌদ্দগুষ্টিকে  আশীর্বাদ করতে শুরু করলেন তা কেবলমাত্র পল্লীগ্রামের কতিপয় দুঃসাহসীর পক্ষেই সম্ভব।

 পিসির হাত থেকে যখন তারা নিষ্কৃতি পেল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ফেরার পথে রকি ফাঁকা ময়দানে তার কাল্পনিক বীরত্ব প্রকাশ করতে করতে চলল - শালি আমার হাত থেকে আজ বেঁচে গেল। আর একটু বাড়াবাড়ি করলে শালিকে মেরে ওখানেই পুঁতে ফেলে আসতাম............ ইত্যাদি ইত্যাদি।

 পরদিন স্কুলে সোমা এই ঘটনা নিয়ে মজলিস গরম করে তুলল। সোমা শিলার কাকাতো বোন এবং ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী। সুতরাং বিনা বাধায় ঘটনাটিও ধীরে ধীরে রঙিন থেকে রঙিনতর হতে শুরু করল। 

 গল্প শেষ করে সোমা পিয়াকে বলল, -- আজ আমি তোর নতুন ভক্তকে নিয়ে একটু মজা করব। এই রুমা, আমার সঙ্গে চল, রাজুর সঙ্গে একটু মজা করে আসি। আজ ওকে টিওবয়েলের পাশে গিয়ে ধরবো। তারপর পিয়ার সামনে নিয়ে আসবো।
  এবার পিয়া বলল, -- পারবি না তুই ওকে আমার সামনে আনতে।
  -- হয়ে যাক চ্যালেঞ্জ।
  -- ঠিক আছে, তুই যদি ওকে আমার সামনে এনে হাজির করাতে পারিস তাহলে জানব তোর বুকে দম আছে - জানবো তুই প্রকৃতই বীর।
  সোমা এবার হাসতে হাসতে বলল,-- এ তো মেরা বাঁয়ে হাত কা খেল।

  স্কুলের মধ্যেই একটি টিউবয়েল। আরেকটি টিউবওয়েল আছে সামনের খেলার মাঠ পেরিয়ে পঞ্চায়েত অফিসের পাশে। রাজু নিয়মিত ক্লাসে ঢোকার আগে পঞ্চায়েতের পাশের টিউবয়েল থেকে জল পান করে আসে। আজও সে যথারীতি জল পান করতে গেল; এমন সময় তার পাশে ফিক্ ফিক্ করে হাসতে হাসতে এসে দাঁড়ালো সোমা।

 রাজু এই স্কুলে ক্লাস নাইনে নতুন ভর্তি হয়েছে। আগে যে স্কুলে সে পড়তো সেখানে সে ছিল ফার্স্ট বয়। অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির ছেলেটি সহজে কোন মেয়েকে লজ্জায় কথা বলতে পারতো না। সৌন্দর্যের প্রতি ছিল তার তীব্র আকর্ষণ। প্রকৃতির অসামান্য রূপ সে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে ভালোবাসতো। মানুষ, পশু, গাছপালা প্রত্যেকের মধ্যেই সে নতুন কোন সৌন্দর্য আবিষ্কার করার চেষ্টা করতো। কোন দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে প্রায়ই নিজেকে হারিয়ে ফেলতো।
 এই স্কুলে আসার পর পিয়ার মধ্যে সে কি যেন একটা খুঁজে পেল। প্রায়ই তার দিকে আত্মহারা হয়ে তাকিয়ে থাকতো। দূরে থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে পিয়াকে দেখতো, অথচ কাছে এলেই সে মুখ নিচু করে অন্যদিকে চলে যেত। তার এসব 'অদ্ভুত' চলাফেরা দেখে ওরা ভীষণ মজা পেত। তাদের সেই মজাটাকে আরো ভালোভাবে উপভোগ করার জন্য সোমার আজ টিউবয়েলের পাশে আগমন ঘটলো।

  রাজুর দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে সোমা মিষ্টি-কোমল স্বরে প্রশ্ন করল, - এই, তোমার নাম রাজু?
  হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন! রাজু থতমতো খেয়ে গেল; তারপর কোনমতে নিচু দিকে মুখ করে জবাব দিল - হ্যাঁ।

  নিজের কর্তব্য-কর্ম সমাপ্ত হয়েছে ভেবে সে সেখান থেকে চলে যেতে উদ্যত হল। কিন্তু সোমা তাকে থামিয়ে দিল - এই, তুমি আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে?

  এবার রাজু চরম অবাক হয়ে সোমার দিকে তাকালো। তারপর ভয়ে ভয়ে জবাব দিল, - কি কাজ?
  -- পরশুদিন তো পিয়া ইস্কুলে আসেনি। যদি তুমি ওর সামনে গিয়ে বলতে পারো যে ও সেদিন স্কুলে এসেছিল, তাহলে আমরা মিষ্টি খেতে পাবো। তোমাকে এর বেশি কিচ্ছু করতে হবে না। বলো পারবে তো?

রাজুর সমস্ত শরীর থেকে যেন মুহূর্তের মধ্যে ঘাম ঝরতে শুরু করল। কি উত্তর দেবে, কি করবে কিছুই সে বুঝতে পারল না। তার কেবলই মনে হতে লাগলো এখান থেকে পালিয়ে গেলেই বুঝি বেঁচে যায়। কোন রকমে কাষ্ঠ হাসি হেসে কি একটা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল; কিন্তু গলা থেকে কোন আওয়াজই বেরোলো না - গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
  অতঃপর কোন উপায় না দেখে সে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। পেছন থেকে সোমা দু-একটি কথা জিজ্ঞেস করতে গেল, কিন্তু কোন কথাই তার উত্তপ্ত কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো না।

  সোমা তার বান্ধবী দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, - চল্ তো; ওকে ঐ দিকে গিয়ে ধরবো।
  তিনজনে দ্রুত স্কুল বিল্ডিং এর দোতালার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। এই বারান্দার নিচু তলাতেই রাজুদের ক্লাস রুম। রাজু যখন নিজেকে ধাতস্ত করে তার বন্ধু শুভাশিসের সঙ্গে ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়াতে যাবে এমন সময় দোতলার বারান্দা থেকে আওয়াজ ভেসে এলো - রাজু, আমার কলমটা নিচে পড়ে গেছে। প্লিজ একটু তুলে দাও না।
  রাজু ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলো সোমা দল বল নিয়ে হেসে হেসে হাতের ইশারায় নিচে পড়ে যাওয়া কলম দেখাচ্ছে।

 দলবল দেখে রাজুর পিলে চমকে গেল। সে নিচু দিকে মুখ করে সোজা ক্লাসরুমের সামনে তাদের থেকে আড়াল হয়ে দাঁড়ালো। তারপর শুভাশিসকে বলল, - ওদের কলমটা তুলে দিয়ে আয় তো!
 বেচারা শুভাশিস কলম খুঁজতে গিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। তখন উপর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, - কোথায় কলম?
  প্রত্যুত্তরে উপর থেকে ছুটে এলো একদল কিশোরী ছাত্রীর হাসির ফোয়ারা। মুখ চাপা দিয়ে খিল খিল করে হাসতে হাসতে তারা সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
 শুভাশিস লজ্জায় মুখ লাল করে সেখান থেকে ফিরে এলো। রাজু জিজ্ঞেস করল, - কি হলো?
 শুভাশিস উত্তর দিল - ছিঃ! এত বড় অপমান!

  পরদিন স্কুলে রাজু ক্লাসের দিকে যেতে যেতে আবার শুনতে পেল - এই রাজু, কলমটা তুলে দাও না, প্লিজ?
  রাজু হয়তো বাংলা ভাষার সুপ্রসিদ্ধ বাক্যটি খুব ভালোভাবে জানত - ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়। সুতরাং বাক্যটির সদুপদেশ অক্ষরে অক্ষরে গ্রহণ করে সে ক্লাসরুমে গিয়ে গা ঢাকা দিল।
  জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, সত্য সত্যই আজ মেঝেতে একটি কলম পড়ে আছে। ক্লাস ফাইভের এক ছাত্রী কলমটি কুড়িয়ে তা কলমের মালিক কে ফিরিয়ে দিতে গেল। কিন্তু একি আশ্চর্য! কলমটি ফিরিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে মালিক পরোপকারী ছাত্রীটির কান মুলে দিয়ে শিক্ষা দিল - তোকে কলম তুলতে বলেছি? কার হুকুমে তুই কলমে হাত দিলি?
 বেচারী বাচ্চা মেয়েটি অবাক হয়ে মনে মনে ভাবতে শুরু করল - স্কুলে কারো উপকার করতে গেলে কি কানমলা খেতে হয়? হয়তো হতেও পারে ; এটাই হয়তো হাই স্কুলের নিয়ম!

  শুভাশিস ক্লাসে এলে দুই বন্ধুতে মিলে শলা-পরামর্শ শুরু হয়ে গেল। রাজুর কিভাবে যেন বিশ্বাস জন্মেছিল যে তাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করার মূল নাটের গুরু হচ্ছে পিয়া। সুতরাং বিস্তর আলোচনা করে দুজনে মিলে ঠিক করল যে পিয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলা দরকার। কিন্তু কথা বলবে কিভাবে? কথা বলার সাহস যে তার মধ্যে নেই! অনেক ভেবে চিন্তে, মাথা চুলকে অবশেষে তারা এক চমৎকার উপায় বের করল। রাজু লিখবে চিঠি, আর তাতে তার সমস্ত বক্তব্য লিপিবদ্ধ থাকবে; আর সে চিঠি অতি সন্তর্পণ পিয়ার কাছে পৌঁছে দেবে শুভাশিস। যেহেতু রাজুর থেকে শুভাশিসের সাহস বেশি, তাই গুরু দায়িত্ব চাপলো তার কাঁধেই।

 এখন প্রশ্ন হল কিভাবে লোক চক্ষুর আড়ালে সে চিঠি পৌঁছানো যায় পিয়ার কাছে? সে উপায়ও বেরিয়ে গেল খুব সহজেই।

  পরদিন স্কুলে ছুটির ঘন্টা বেজে গেল। ছাত্র-ছাত্রীরা হৈ-হুল্লোড় করে যে যার বাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করল। পিয়া আম বাগানের ভেতর দিয়ে শর্টকাট পথে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে। সে স্কুল থেকে বেরোতেই শুভাশিস তাকে অনুসরণ করতে শুরু করল। একসময় আম বাগানের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে পিয়া হঠাৎ চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো শুভাশিস দ্রুত হেঁটে তাকে পাস কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। পিয়া হাঁটার গতি কমিয়ে ফেলল। শুভাশিস তাকে পাস কাটিয়ে সামনে চলে এলো। তারপর পিয়ার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল - তো... তোমাকে এ... একটা জিনিস দেব....নে.... নেবে?
  পিয়ার বুকটা হঠাৎ ঢিপ ঢিপ করে উঠলো। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, - কি?
  এবার শুভাশিস কিছুটা সাহস পেল। সে পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে পিয়ার দিকে এগিয়ে ধরল - রাজু এটা তোমাকে দিতে বলেছে। 
  কিন্তু পিয়া হাত বাড়িয়ে চিঠিখানা আর নিতে পারল না। হঠাৎ যেন তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো, বুকের মধ্যে যেন ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। সে নিজেকে একটু শক্ত করে নিয়ে কড়া ভাবে উত্তর দিল, - আমি ওসব নিতে পারবো না।
 
  শুভাশিস এবার তাকে কি একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু পিয়া সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। কিছু দূর যাওয়ার পর থমকে দাঁড়িয়ে একবার পিছন ফিরে তাকালো।
   এবার শুভাশিসের বুকটা দুরু দুরু করে উঠলো। তার মনে হতে লাগলো যে সে একটা বিশাল অন্যায় কাজ করে ফেলেছে। একটা মেয়েকে এভাবে আম বাগানে একা পেয়ে চিঠি দিতে আসা - সেটা ভীষণ অন্যায়। পাশাপাশি তার মনের মধ্যে ভয় জমতে শুরু করল যদি পিয়া স্কুলের স্যারকে এই ঘটনা বলে তাকে মার খাওয়ায় কিংবা অন্য কাউকে যদি বলে দেয়..... পরিণতি চিন্তা করে তার মাথা ঘুরে গেল। আর কাল বিলম্ব না করে সে দ্রুত সেখান থেকে ফিরে এলো। কিছু দূরে রাস্তার উপরে সাইকেল নিয়ে রাজু দাঁড়িয়ে ছিল; শুভাশিষকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসতে দেখে জিজ্ঞাসা করল, - চিঠি দিতে পেরেছিস?
   শুভাশিস পকেট থেকে চিঠিখানা বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শুধু বলল, - এখান থেকে আগে পালিয়ে চল্! পরে বলছি।



তৃতীয় পরিচ্ছেদ



সুমন রাজুর বন্ধু। একসময় তারা একই সঙ্গে পড়াশোনা করতো। তখন তাদের বন্ধুত্ব ছিল খুব ঘনিষ্ঠ। সেদিন বিকেলবেলা সুমন রাজুর সঙ্গে জমিয়ে গল্প শুরু করে দিল, - তোকে বেশ কিছুদিন থেকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো করবো ভাবি আর ভুলে যাই। আচ্ছা তুই আমার মেয়েকে কিভাবে চিনলি?
   রাজু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, - তোর মেয়ে?
  -- হ্যাঁরে, পিয়া যে সম্পর্কে আমার মেয়ে হয় রে! ও হচ্ছে আমার মামাতো ভাইয়ের মেয়ে, অর্থাৎ আমার নিজেরই মেয়ে বলতে পারিস। তা তুই ওকে কবে থেকে চিনিস?

  রাজু একটু লজ্জা পেয়ে বললো, - কেন? এসব কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
  -- বারে! জিজ্ঞেস করবো না? মেয়েটি আমার তোর কথা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারে আর আমি ওর কথা তোকে জিজ্ঞেস করতে পাবো না?

  রাজু এবার অবিশ্বাসের সুরে বলল, - পিয়া আমার কথা তোকে জিজ্ঞেস করেছে? বাজে কথা বলার জায়গা পাওনা?
  -- তোর বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে বলি শোন, এই কিছুদিন আগে থেকে আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা হলে ও প্রায়ই আমাকে হাসতে হাসতে বলে 'আর' তোমাকে ডেকেছে। আমি ঘুরিয়ে যখন ওকে জিজ্ঞেস করি 'আর' টা আবার কে রে? তখন ও "আর' কে চেনো না?" বলেই মুখ চেপে হাসতে হাসতে সেখান থেকে চলে যায়।
 আমি মহা ফ্যাসাদে পড়ে গেলাম। তুই তো জানিস যে আমি রানী কে ভালবাসি। রানী নামের প্রথম অক্ষর হচ্ছে 'আর'। আমি মনে মনে ভাবলাম যে ওকি তবে রানীর কথা সব জেনে ফেলল!..... এসব ভেবে আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম। শেষে একদিন আমি ওকে একা পেয়ে ধরলাম; বললাম, 'আর' এর কথা আজ তোকে বলতেই হবে। না বললে আজ আমি তোকে ছাড়ছি নে। কোন উপায় না পেয়ে মেয়ে আমার শেষে বলল, "আর' কে চেনো না? 'আর' হচ্ছে তোমার বন্ধু রাজু।"
 আমি শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। ওকে বললাম, - রাজু তো কোন মেয়েকে ঠিকভাবে কথাই বলতে পারেনা; আর তোকে দিয়ে ডেকে পাঠাবে আমাকে? আচ্ছা ঠিক আছে, কালকেই আমি ওকে জিজ্ঞেস করছি।
 এবার মেয়ে আমার ভয় পেল, কি লজ্জা পেল জানিনা, আমায় জোর গলায় অনুরোধ করতে শুরু করল, - না না না না না.... খবরদার খবরদার.... রাজুকে আমার কথা কিচ্ছু বলো না। আমি এমনি তোমাকে ইয়ার্কি করে বলেছি।
  এবার তুইই বল্ মেয়ের কথা শুনে আমি কি ভাববো?...... তা মেয়ের সঙ্গে কবে থেকে তোর সম্পর্ক শুরু হয়েছে?

  -- সম্পর্ক! ওকে আজ পর্যন্ত আমি কথাই বললাম না; তার আবার সম্পর্ক!
  -- কথা বলিস নি তো ও আমাকে তোর কথা বলল কেন?
  -- হয়তো বলেছে, কেন বলেছে তা আমি বলতে পারব না। তবে এটা লক্ষ্য করেছি যে ওরা আমাদের দিকে তাকায় আর নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কি সব আলোচনা করে। আচ্ছা, গত চার পাঁচ দিনের মধ্যে কি তোর সঙ্গে ওর কথা হয়েছে?
  -- এমনি দেখা হয়েছে - কিন্তু কোন কথা হয়নি।

  এবার রাজু মাথা চুলকে এদিক সেদিক তাকিয়ে কি একটা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু তা বলতে তার সংকোচ হতে লাগলো। এবার সুমন তার গায়ে একটা খোঁচা মেরে দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, - এত দ্বিধা কিসের? বলেই ফেলনা কি বলতে চাস! আমি তো আর বাঘ ভাল্লুক নই যে তোকে খেয়ে ফেলবো!
  -- না, সেরকম কিছু না... আসলে আজ কয়েক দিন হল আমি একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছি, পিয়াকে একটা চিঠি দিতে গিয়ে বিপদে পড়ে গেছি রে!
  -- চিঠি! পিয়াকে চিঠি দিয়েছিস তুই?
  -- নারে, সেরকম কোন চিঠি নয়...... আগে ব্যাপারটা শুনবি তো তুই আমার কাছে।

  সোমার কলম ফেলা থেকে শুরু করে শুভাশিসের বাগানের মধ্যে চিঠি দিতে যাওয়া পর্যন্ত, সমস্ত ঘটনাই সে আনুপূর্বীক সুমনকে শোনালো।

  শেষে বললো, - এখন আমি পিয়াকে বোঝায় কিভাবে যে চিঠির মধ্যে সেরকম কোনো আজেবাজে প্রস্তাব ছিল না। ও তো নিশ্চয়ই ভেবে বসে আছে যে আমি ওকে প্রেম করার জন্য চিঠি পাঠিয়েছি। ও যদি চিঠিখানা নিয়ে নিত তাহলে তো কোন সমস্যাই ছিল না। চিঠি পড়েই ও বুঝে ফেলতো আমি ওকে কি বলতে চেয়েছি।
  -- তুই আমাকে সত্যি করে বলতো তুই চিঠিতে কি লিখেছিলি?
  -- তোকে আমি মিথ্যা কথা বলব?... আমার কথা তোর বিশ্বাস হচ্ছে না?
  -- আরে না না! আমি তোকে অবিশ্বাস করবো কেন? তোকে তো আমি খুব ভালোভাবেই চিনি। তবুও একবার শুনি না চিঠিতে কি লেখা ছিল?
  -- আমি চিঠিতে লিখেছিলাম যে আমি পিয়ার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাই। ওর যদি আমাকে কিছু বলার থাকে তাহলে যেন ও আমাকে তা সরাসরি বলে, এভাবে কলম ফেলে ওরা যেন আমাকে আর বিরক্ত না করে। শেষে অনুরোধ করে লিখেছিলাম যে ও যেন আমার চিঠির কথা কাউকে না জানায়।
  -- তোর কাছে কি চিঠিটা এখন আছে?
  -- না। সেদিনই ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়েছি।
  -- ঠিক আছে তুই চিন্তা করিস না। ও যদি সত্যই কিছু ভুল বুঝে থাকে তাহলে আমি তা ঠিক করে দেব।

  পিয়াদের বাড়ি থেকে কয়েকটা বাড়ি অতিক্রম করলেই সুমনদের বাড়ি। সুমনের বোনের সঙ্গে পিয়ার ঘনিষ্ঠ সখিত্ব। সুতরাং প্রায়ই পিয়া এই বাড়ি এসে গল্প গুজব করে সময় কাটিয়ে যায় বিকেলবেলা সুমন বাজার থেকে ফিরে এসে দেখল, দুই বান্ধবী মিলে খুব হেসে হেসে হাত নেড়ে কি একটা ঘটনার ব্যাখ্যা দিচ্ছে। 
তাকে দেখে একজন হাসি থামিয়ে চুপ করে গেল। অন্যজনের দিকে তাকিয়ে সুমন বললো, - কিরে, অত ফুর্তি কিসের? আজকাল যে তোর কি সব ব্যাপার স্যাপার ঘটছে?...... কিছুই বুঝতে পারছিনা! 
  তারপর সাইকেলখানা দেয়ালে ঠেস দিতে দিতে আবার মুচকি হেসে বললো, - তোর একটা গরম গরম খবর আছে ..... পরে বলবো।

  পিয়ার ভেতরটা হঠাৎ ধুকপুক করে উঠলো। না জানি কি খবর! সে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করে থাকতে পারলো না। কিছুক্ষণ পরেই সুমনের কাছে এসে বলল, - ওসব পরে টরে বুঝি না, কি বলছিলে এখনই বল। 
  সুমনও সুযোগ বুঝে পিয়াকে ধাঁধার মধ্যে রেখে কিছুক্ষণ হেঁয়ালি করে কাটিয়ে দিল।

  এবার পিয়া বিরক্ত হয়ে উঠে যাচ্ছে দেখে সুমন আসল কথায় ফিরে এলো, - তোরা নাকি বান্ধবীরা মিলে দল বল বেঁধে রাজুর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকিস?

  পিয়া ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, - তোমাকে এসব কথা কে বলেছে?
  -- কে আর বলবে? তোরা যার দিকে তাকিয়ে থাকিস, তার মুখ থেকেই এসব শুনেছি।
  -- রাজুর কাছ থেকে শুনেছ?..... আমরা ওর দিকে তাকিয়ে থাকি?....... 
  এটুকু বলেই পিয়া সশব্দে হি হি করে হেসে উঠলো। 'রাজু' শব্দটা একবার কোন মতে উচ্চারণ করল, কিন্তু হাসির চোটে এর বেশি উচ্চারণ করা তার পক্ষে সম্ভব হলো না।
  "আমরা ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি?" বলেই আবার এত জোরে হাসতে শুরু করল যে তাকে থামানোই মুশকিল হয়ে গেল। 
  অবশেষে অতি কষ্টে হাসি থামিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে পিয়া বলল, - আমরা ওর দিকে কেন তাকাই জানো? ও স্কুলে গিয়ে বই খাতা রেখেই সোজা বারান্দায় এসে দাঁড়াবে....  তারপর আমি যতক্ষণ সামনে থাকবো ও পাগলের মত এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েই থাকবে। ও এমন ভাবে আমার দিকে তাকায় যে তুমি যদি দেখো তাহলে তুমিও হেসে ফেলবে।আমার বান্ধবীরা সেজন্য ওর কথা নিয়ে তামাশা করে আর ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসে। এই সেদিনই ও এমন ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিল' - বলেই পিয়া আবার হাসির ঝংকারে বাতাস কাঁপিয়ে দিল।
  ওর হাসির সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষন সুমনও হাসছিল। এবার শান্ত হয়ে পিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, - তুই রাজুর চিঠি নিস নি কেন?

  পিয়া যেন আকাশ থেকে পড়ল। মুহুর্তের মধ্যে তার ভুবন ভোলানো হাসির ঝংকার স্তব্ধ হয়ে গেল। কঠিন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সুমনের দিকে তাকিয়ে শেষে মুখ নিচু করে বলল, - তুমি কি করে জানলে?
  -- বারে! আমি জানব না? আমার বন্ধুর খবর আমি জানব না?
  -- ও কি তোমার খুব প্রিয় বন্ধু?
  -- তুই কি ভাবিস?
  -- না, মানে ভাবতাম। কিন্তু এখন দেখছি তোমাদের মধ্যে সবকিছুই আলোচনা হয়‌। তোমার বন্ধু কিন্তু ওভাবে চিঠি পাঠিয়ে খুব একটা ভালো কাজ করেনি।
  -- তুইও চিঠিটা না নিয়ে খুব একটা ভালো কাজ করিস নি।
  -- কেন?
  -- চিঠিটা নিয়ে তুই দেখতে পারতিস, ওর মধ্যে কি লেখা আছে। তুই তো না জেনে অনেক কিছুই ভেবে বসে আছিস।
  -- থামো থামো! তুমি কি ওর চিঠিটা পড়ে দেখেছো?
  -- আমি পড়িনি ঠিকই; কিন্তু খুব ভালোভাবেই জানি ওর মধ্যে কি লেখা ছিল। তোরা নাকি স্কুলে কলম ফেলে ওকে জ্বালাতন করিস?

  এবার পিয়া ফিক করে হেসে ফেলল, - আমি ফেলি নাকি? ঐ সোমারাই ওসব কীর্তি করে। আমি নিষেধ করলেও আমার কথা গ্রাহ্যই করে না।
  -- সে যেই ফেলুক না কেন, তোদের দল থেকেই তো কলমটা পড়ে নাকি? রাজুর চিঠিতে সেই কলম ফেলার কথাই লেখা ছিল। তোরা যাতে কলম ফেলে আর ওকে না জ্বালাতন করিস সেই অনুরোধ করতেই তোকে ও চিঠি দিতে চেয়েছিল। চিঠিতে আজেবাজে কথা একটাও লেখা ছিল না।

  পিয়া গালে হাত দিয়ে কি যেন ভাবতে লাগলো। সুমন কথা বলা বন্ধ করে দিলেও সে তেমনি ভাবে চুপচাপ বসে থাকলো।
  -- কি হল চুপ করে গেলি যে ! কিছু বল ?

  এবার গাল থেকে হাত নামিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ত্যাগ করে পিয়া প্রতিশ্রুতি দিল, - ঠিক আছে, আজ থেকে রাজুকে স্কুলে আর কেউ জ্বালাবে না।
 




চতুর্থ পরিচ্ছেদ





  সেদিন বিকেল বেলা কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে সান্ধ্য আড্ডা বেশ জমে উঠলো।
  -- জানিস রাজু, যে মেয়ে যত বেশি কড়া হয় সে তত তাড়াতাড়ি পটকে যায়।
  -- তুই কি কোন কড়া মেয়েকে পটকাতে পেরেছিস?
  এবার রকি নামে রাজুর বন্ধুটি বলতে শুরু করল, - পিয়াকে তো তোরা চিনিস। আজ পর্যন্ত কেউই ওর কাছে পাত্তা পায়নি। কত ছেলেই না ওকে অফার করল... কিন্তু সবাই ব্যর্থ। অথচ চয়ন দু-একবার চেষ্টা করেই পিয়াকে এমন ভাবে পটকেছে যে ওর জন্য পিয়া একেবারে পাগল হয়ে গেছে।

  রাজুর ভেতরটা হঠাৎ ছ্যাত করে উঠলো। মাঝপথে সে প্রতিবাদ করল, - এ হতেই পারেনা। সব গাঁজাখুরি গল্প।
  -- গাঁজাখুরি ? তোর বিশ্বাস হচ্ছে না ? চয়ন যে আমার প্রিয় বন্ধুরে । ওর সব কথাই আমি জানি। এই কয়েকদিন আগেই ওরা বহরমপুর গিয়ে সিনেমা দেখে এলো। পিয়া ওর মামার সঙ্গে বহরমপুর গিয়েছিল। তার আগেই তাদের যাবার কথা পিয়া চয়নকে জানিয়ে দিয়েছিল। আর এই সুযোগেই ওরা পাশাপাশি বসে সিনেমা দেখা দেখে চলে এলো ...... অথচ ওর মামা ওদের পাশে থেকেও কিছুই বুঝতে পারল না।

  এবার রাজুর মনের মধ্যে যেন আগুন জ্বলে উঠলো । রকির সমস্ত কথাগুলি যেন আগুনের শিখা হয়ে তার সমস্ত কলিজাকে পুড়িয়ে দিতে লাগলো। অথচ এত বেদনা কিসের? পিয়ার সঙ্গে তো তার কোন প্রেমের সম্পর্ক নেই? পিয়া কাকে ভালোবাসলো আর না বাসল তাতে তার কি এসে যায়? সে তো কোনদিন পিয়াকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়নি?.... প্রস্তাব দেয়নি ঠিকই ; কিন্তু মনে মনে সে দিন-রাত পিয়াকে নিয়ে নানা প্রকার বাস্তব-অবাস্তব কল্পনায় মেতে থাকতো।
 বই নিয়ে পড়তে বসলে বইয়ের পাতা থেকে সমস্ত অক্ষরগুলি অদৃশ্য হয়ে যেত। তার চোখের সামনে ভেসে উঠতো পিয়ার মুখের জাদু মাখা পাগল করা হাসি। স্কুলের মধ্যে পিয়াকে নিয়ে কোন এক আশ্চর্য ঘটনা মনে মনে কল্পনা করে নিত আর তাতে ভীষণ মজা পেয়ে সে একা একা বসে বসে ফিক ফিক করে হাসতো।
  অথচ আজ পর্যন্ত সে কোন বন্ধুকে বলতে পারেনি যে সে পিয়াকে ভালোবেসে ফেলেছে। পিয়ার সাম্রাজ্যতা ছিল তার মনের মধ্যে .... একান্ত আপন ...... সম্পূর্ণ আলাদা..... সেখানে প্রবেশের অধিকার অন্য কোন দ্বিতীয় ব্যক্তির ছিল না।

  আজ হঠাৎ রকির কথা শুনে তার হৃদয়ের সিংহাসনটি টলোমলো করে উঠলো। সে কোন মতেই বিশ্বাস করতে পারল না যে পিয়া অন্য কাউকে ভালবাসতে পারে। কিভাবে যেন তার মনের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে পিয়াও নিশ্চয়ই তাকে ভালবাসে।

  -- তুই কি নিজের চোখে ওদের কখনো একসঙ্গে কথা বলতে দেখেছিস?
  -- আচ্ছা তুই বলতো, চয়নরা পিয়াদের কে হয়?..... আত্মীয়?.... কিংবা অন্য কিছু?... কেউ না। ওদের সঙ্গে পিয়াদের কোন সম্পর্কই নেই। অথচ কালকে বিকেলবেলা আমি নিজের চোখে দেখলাম পিয়ার মা চয়নদের বাড়ি গিয়ে প্রায় দেড় ঘন্টা মতো গল্প করে এলো। এবার তুই ভাব ওদের বাড়ি পিয়ার মা গেল কেন?

  রাজুর মাথা হেঁট হয়ে গেল। আর কোনরকম প্রশ্ন করার মত শক্তি তার মনের মধ্যে নেই। ধীরে ধীরে সে ভাবতে লাগলো, হয়তো হতেও পারে। অন্ততপক্ষে না হওয়ার কোন কারণ নেই। যেহেতু চয়ন বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে। পিয়ার বাবা-মা হয়তো চয়নের সঙ্গে তাদের একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিতে চায়!..... আর বেশি কিছু সে ভাবতে পারল না ; মাথাটা যেন টনটন করে উঠলো।

  পরদিন সুমনের সঙ্গে রাজুর দেখা হয়ে গেল।
 গল্প করতে করতে এক ফাঁকে রাজু প্রশ্ন করল, - পিয়া আমার কথা এখন আর তোকে জিজ্ঞেস করে না?
  -- কই, কিছুদিন থেকে ওর সঙ্গে আমার আর দেখা হচ্ছে না।  তোর সেই চিঠি দেওয়ার ঘটনার পর থেকে ও প্রায়ই আমার কাছে আসত আর তোর কথা শুনতে চাইত। কিন্তু এখন ও আমাদের বাড়ি আসে খুব কম।
  -- তুই কি জানিস যে তোর মেয়ে অন্য কাউকে ভালোবাসে?
  -- তোর মত একটা সুন্দর জামাই থাকতে মেয়ে আর অন্য কার দিকে হাত বাড়াবে?..... তুই কি আমার মেয়েকে সামলাতে পারছিস নে নাকি?
  -- নারে, ইয়ার্কি না। শুনলাম তোর মেয়ে নাকি চয়ন কে ভালোবাসে?
  -- শুনছি তো আমিও অনেক কিছুই। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেয়েকে এ ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস করা হয়নি। আর জিজ্ঞেস করলেই যে বলবে তাতেও বিশেষ ভরসা নেই। এখন শুনছি মেয়ে ওদের বাড়ির পাশের বাড়ি থেকে ফোনে চয়নের সঙ্গে কথা বলে। ছোঁড়া ফোন করলেই নাকি ওরা পিয়াকে ডেকে দেয়।

  এবার সত্য সত্যই রাজু তার হৃদয়ের মধ্যে পিয়ার জন্য যে স্বপ্নপুরী বানিয়ে রেখেছিল তা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল। মনের মধ্যে এক অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করতে শুরু করল। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল আর কখনো পিয়ার সামনে যাবেনা ...... তার কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করবে । এই অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য থেকে সে মুক্তি পেতে চায়।




পঞ্চম পরিচ্ছেদ



জানুয়ারি মাস। ইংরেজি নতুন বছরের শুরু। চারিদিকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাবার ধুম পড়ে গেল। দোকান থেকে হুহু করে বিকোতে লাগলো গ্রিটিংস কার্ড। ছাত্র-ছাত্রী, বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে গ্রিটিংস কার্ডের আদান-প্রদান শুরু হয়ে গেল।

  সন্ধ্যাবেলা জ্যাকেট গায়ে দিয়ে সুমন হাসতে হাসতে রাজুকে বলল, - কিরে, নতুন বছরে কাউকে গ্রিটিংস ফিটিংস কিছু দিলি না?
  -- আমার কে আছে যে গ্রিটিংস দেবো?
  -- কেন? আমার মেয়ে আছে তো ! না ওকে ভুলে গেলি?
  -- আমার মত ছেলে কি তোর মেয়ের যোগ্য যে গ্রিটিংস দিতে যাব? আর দিলেও হয়তো তোর মেয়ে তা নেবে না।
  -- তুই আমার মেয়েকে এরকম ভাবিস? তুই যা ভাবিস তা ভুল। আমার মেয়ে অন্য কারো মতো অহংকারী নয় রে ! তুই ওর সঙ্গে মেলামেশা করিস নি বলে ভুল বুঝেছিস।......... আচ্ছা ধর, তুই ওকে গ্রিটিংস দিলি না। আমার মেয়েই তোকে প্রথমে গ্রিটিংস দিল। তাহলে তুই কি করবি?
  -- যা অবাস্তব তা ভেবে লাভ আছে?
  -- ধর বাস্তব। যদি তাই হয় তাহলে কি তুই ওকে পরিবর্তে একখানা গ্রিটিংস দিবি, না দিবি না?

  কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা চুলকে রাজু বলল, - সেই সৌভাগ্য যদি আমার হতো তাহলে আমি ওকে খুব দামী একটা গ্রিটিংস দিতাম।

  এবার সুমন হাসতে হাসতে ঝড়ের গতিতে তার জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে একখানা ছোট সাইজের গ্রিটিংস কার্ড বের করে তার মুখের সামনে তুলে ধরল, - তোর সেই সৌভাগ্য হয়ে গেছে। মেয়ে আমার তোর জন্য গ্রিটিংসটা পাঠিয়েছে।

  রাজু গ্রিটিংসটা হাতে নিয়ে দেখলো তাতে কিছুই লেখা নেই, সম্পূর্ণ ফাঁকা। সুমনের হাতে আবার সেটি ধরিয়ে দিতে দিতে রাজু বলল, - ধ্যাত্! কোথা থেকে কুড়িয়ে এনে আমার কাছে নাম কামানোর চেষ্টা? আমি কি বোকা না পাগল? 

  সুমন গ্রিটিংস টা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। তারপর কৃত্রিম গাম্ভীর্যতা দেখিয়ে বলল, - তুই ভাবছিস এতে কিছু লেখা নেই বলে আমি কুড়িয়ে এনেছি? আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যদি তোকে এখনই পিয়ার হাতের লেখা গ্রিটিংস তোকে দিতে পারি তাহলে তুই আমাকে কি দিবি বল্ ?
  -- তুই যা চাইবি আমি তাই দেব।
  -- তোর কাছে খুব বেশি কিছু চেয়ে আমি তোকে ভিখারি বানাবো না। আমাকে শুধু পেট ভরে মিষ্টি খাওয়াতে হবে; ব্যস।
  -- আচ্ছা ঠিক আছে, তাই হবে।

  সুমন তার জ্যাকেটের ভেতর পকেটে আবার হাত ঢুকালো - বেরিয়ে এলো এক বড় সাইজের খাম। তার ভেতর থেকে বেরোলো এক সুদৃশ্য চকচকে গ্রিটিংস কার্ড। প্রথমে লেখা আছে রাজুর নাম। শেষে লেখা আছে পিয়ার নাম। মধ্যে লেখা আছে নতুন বছরকে শুভেচ্ছা জানাবার কয়েকটি বাক্য। রাজু হঠাৎ খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে উঠলো। এমন এক আনন্দের ঝড় তার মনের মধ্যে বয়ে গেল যা এর আগে সে কখনো টের পায়নি। আজ যেন তার জীবনটা সম্পূর্ণ এক নতুন জীবনে পরিণত হলো।

  মিষ্টি খেয়ে, ঢেকুর তুলে, হাত নেড়ে, মুচকি হেসে সুমন রাজুকে বলল, - তাহলে তোর দামি গ্রিটিংসটা এবার কবে চালান দিচ্ছিস?
  -- তুই যেদিন দিতে পারবি।
  -- আমি দিতে পারব মানে?
  -- আমি লিখে দেব, তুই ওকে গিয়ে দিয়ে দিবি।
  -- আমি কি তোদের পিয়ন? ওরটা না হয় এনে দিলাম; তোরটা কোন দুঃখে নিয়ে যাব রে?
  -- তাহলে কাকে দিয়ে ওর কাছে গ্রিটিংসটা পাঠাবো?
  -- ওসব কাকে টাকে ছাড়। নিজে গিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আসবি। আর যদি নিজে না পারিস তাহলে প্রেম করার আশা ছেড়ে দিয়ে বনে জঙ্গলে গিয়ে বসে থাকিস।

  অনেক কষ্টে, অনেক ভেবে, সাহসে ভর দিয়ে শেষে রাজু পিয়ার কাছে যেতে রাজি হয়ে গেল। ঠিক হলো আগামীকাল সুমন পিয়াকে জিজ্ঞেস করে এসে রাজুকে জানাবে কোথায় কখন সে পিয়াকে গ্রিটিংসটা দেবে।

  পরদিন সুমন এসে জানিয়ে দিল, আগামী পরশু রাজুকে স্কুলে গিয়ে পিয়ার সঙ্গে দেখা করতে হবে। টিফিনের সময় পিয়া স্কুলের বাইরে এসে দাঁড়াবে আর তখনই রাজু তাকে গ্রিটিংসটা ধরিয়ে দেবে।

  আজ রাজুর মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আনন্দের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনটাও কেঁপে কেঁপে উঠছে। আজ সে যে গ্রিটিংসটা লিখবে তা পিয়া নিজের হাতে নিয়ে, নিজের চোখ দিয়ে দেখে দেখে পড়বে...... ভাবতেই তার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। কি লিখবে সে? এমন কোন ভাষা সে ব্যবহার করবে যা দিয়ে সে নিজেকে পিয়ার সামনে তুলে ধরতে পারে?
  কবিতা লেখার অভ্যাস আছে তার। মাঝে মাঝে গালে হাত দিয়ে বসে বসে এই পৃথিবীর নানাপ্রকার আশ্চর্য সব কাণ্ডকারখানার কথা সে চিন্তা করে। কখনো কখনো উদাস হয়ে ভাবতে ভাবতে খাতা কলম নিয়ে লিখে ফেলে দু একটি কবিতা। এখন সে যেসব কবিতাগুলি লেখে তার প্রতিটি লাইনে শুধুই পিয়ার মাহাত্ম্যের আধিপত্য। আজ হঠাৎ সে ভেবে পেল না কোন ভাষায় পিয়াকে সম্বোধন করবে.... কোন সিংহাসনে বসিয়ে তাকে গ্রিটিংস কার্ডে স্থাপন করবে !
   দুরু দুরু বুকে সারাদিন ধরে কল্পনা করে শেষে একটি কবিতা লিখল। বহু যত্নে দুই রঙের কালি দিয়ে কবিতাটি গ্রিটিংস কার্ডে এমনভাবে লিখল যে কবিতার মধ্যে লেখার অক্ষরের সাহায্যে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠল 'লাভ' চিহ্ন।

  পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে রাজু স্কুলের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। পথে সুমনের সঙ্গে দেখা হল। গ্রিটিংসটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বলল, - খুব সুন্দর লিখেছিস তো কবিতা! এবার এটা নিয়ে সোজা মেয়ের কাছে চলে যা। কোনরকম লজ্জা করবি না। আমি ওকে ভালোভাবে বলে দিয়েছি যে, তুই স্কুলে গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি, ও নিজেই এসে তোর কাছ থেকে গ্রিটিংস নিয়ে যাবে।

  লজ্জা না করার পরামর্শ নিয়ে গেল বটে, কিন্তু লজ্জা যেন আরো বেশি বেশি মাথা চাড়া দিয়ে রাজুকে সংকুচিত করে দিচ্ছে। স্কুলের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে তার পাশে গিয়ে সে দাঁড়ালো। স্কুলের ভেতরে ঢুকতে তার ভীষণ লজ্জা পেতে লাগলো। অথচ সেও তো এই স্কুলেরই ছাত্র! তবুও..... তবুও আজ কেমন এক জড়তা যেন তাকে ধীরে ধীরে আড়ষ্ট করে তুলছে। আজ হঠাৎ করে তার মনে হচ্ছে যেন এটা পিয়াদেরই স্কুল - এই স্কুলে আজ সে সম্পূর্ণ অপরিচিত বহিরাগত। আর কিছুদিন পরেই তাদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। সুতরাং সে তো কিছুদিন থেকে স্কুল আসেই না তার সহপাঠীরাও স্কুল আসা বন্ধ করে যে যার বাড়িতে বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর সে কারণেই হয়তো তার স্কুলের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।

  টিফিনের ঘন্টা পড়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। রাজুও দাঁড়িয়ে আছে সেই তখন থেকেই। ছাত্র-ছাত্রীরা অনবরত স্কুল ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মুড়িওয়ালা, ঘুগনিওয়ালা। সেখান থেকে টিফিন খেয়ে অনেকেই ঢুকে গেল স্কুলের মধ্যে। টিফিনের সময় প্রায় শেষ হতে চলল; অথচ কোথায় পিয়া? তার টিকিটিও তো দেখা গেল না!
  তাহলে কি পিয়া জানে না যে সে তার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছে? কিন্তু সুমন তো পিয়াকে তার আসার কথা আগেই জানিয়েছে। তাহলে পিয়া এখন পর্যন্ত বাইরে এলো না কেন?
  টিফিন শেষ হবার ঘন্টা বেজে গেল। বাইরে যে সব ছাত্রছাত্রীরা এদিক সেদিক হৈ হল্লা করে খেলাধুলা করছিল তারা সবাই ধীরে ধীরে স্কুলের ভেতরে চলে গেল - পিয়া কিন্তু অদৃশ্যই থেকে গেল।

  এবার রাজুর মনের মধ্যে নানা রকম দুশ্চিন্তা জমতে শুরু করল। তবে কি সুমন তাকে ধোঁকা দিয়েছে? আসলে হয়তো পিয়া গ্রিটিংস সমন্ধে কিছুই জানে না। সুমনই তাকে বোকা বানানোর জন্য স্কুলে পাঠিয়েছে। আর তাকে পাঠানো গ্রিটিংসের লেখা গুলি যে পিয়া নিজের হাতে লিখেছে - তারই বা প্রমাণ কোথায়? সে তো আজ পর্যন্ত পিয়ার হাতের লেখা নিজের চোখে দেখেনি। হয়তো সুমন গ্রিটিংসটা অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়ে তাকে নিয়ে তামাশা শুরু করেছে।
  লজ্জায়, অপমানে, রাগে রাজুর মাথা গরম হয়ে গেল। তার ইচ্ছে হল এখানেই কার্ডটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে। কিন্তু না... ছিঁড়তে হলে সে সুমনের সামনেই ছিঁড়বে। তার সামনে গিয়েই সে তার উপযুক্ত জবাব দেবে।

  বিকেলবেলা সুমন হাসতে হাসতে এসে রাজুকে জিজ্ঞেস করল, - কিরে, পিয়াকে ভালোভাবে গ্রিটিংস টা দিতে পেরেছিস তো? লজ্জা টজ্জা করিস নি তো?

  রাজু কোন জবাব দিল না। পকেট থেকে তার নিজের গ্রিটিংসটা বের করে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল - তারপর দেশলাই বের করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিল। দেখতে দেখতে কার্ডটি পুড়ে ছাই হয়ে বাতাসে উড়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটনাটি ঘটে গেল। সুমন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো; তার মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ কোন কথা বেরোলো না। শেষে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করল, - মেয়ে কি তোকে অপমান করেছে?.... কিংবা অন্য কিছু বলেছে?
  -- তোর মেয়ে অপমান করেনি, তুই অপমান করেছিস।
  -- মানে?
 
  এবার রাজু গরম গরম ঝাল ঝাল শব্দ ব্যবহার করে তার অভিজ্ঞতার কথা জানালো।

  সমস্ত ঘটনাটি শুনে সুমন থ হয়ে গেল। সে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারল না। শুধু এটুকুই সে বলতে পারল, - তুই বিশ্বাস কর, আমি তোর সঙ্গে কোন রকম চালাকি করিনি। মেয়ে যে কেন এরকম করল তা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না। আজ বাড়ি গিয়ে ওর সঙ্গে আমার হবে।....  তবে আমি তোকে এটা প্রমাণ করে দেবো যে আমি তোর সঙ্গে বিন্দুমাত্রও চালাকি করিনি।

  অনেক কথাবার্তা যুক্তি-তর্কের শেষে রাজুর মনটা কিছুটা শান্ত হল। সে দিনের মতো দুজনেই মনোক্ষুন্ন অবস্থায় যে যার বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।

  দুইদিন পর সুমন এসে বললো, - দেখ রাজু, আমি কিন্তু তোদের এই ঝামেলার মধ্যে আর থাকতে রাজি নই। তোরা তোদের মধ্যে কি সব কান্ড ঘটাবি আর মধ্যে থেকে আমার দোষ হবে, আমি তা মেনে নেব না। কালকে পিয়াকেও এই কথাটা জানিয়ে দিয়েছি। রাগের মাথায় ওকেও অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছি। বেচারী খুব দুঃখ পেয়েছে। তোর কাছে আসেনি বলে খুব আফসোস করছিল। আজ সকালে ও আমাদের বাড়ি গিয়ে আমাকে ধরলো । একখানা কার্ড আমার টেবিলে রেখে বলল যে, কার্ডখানা আমি যেন তোকে এসে দিই। আমি কোন মতেই আর তা নিতে রাজি হচ্ছিলাম না। অনেক অনুনয় বিনয় করছে দেখে শেষ রাজি হলাম। কার্ডটা এখন আমার কাছে আছে। তুই কি নিবি? যদি নিস তাহলে দেব...... আর না হলে ফিরিয়ে নিয়ে যাব।

  কিছুক্ষণ চুপ থেকে রাজু হাত বাড়ালো, - কই দেখি?

  কার্ডখানা হাতে নিয়ে সে দেখল, মাঝারি সাইজের কার্ড। নতুন বছরের উদ্দেশ্যে একটি শব্দও তাতে লেখা নেই। চিঠির মতো কয়েকটি বাক্য তাতে লেখা আছে :
 
       I am sorry,

      আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে আপনি স্কুলে যাবেন। জানলে অবশ্যই নিচে নেমে আসতাম। তাছাড়া আপনি কাউকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠাতে পারতেন। এটাও নিশ্চয়ই আপনার ভুল হয়েছে ঠিক আমারই মত। এরপরেও যদি আপনি আমাকে ভুল বোঝেন তাহলে এই কার্ডটি আগুনে পুড়িয়ে ফেলবেন।
                             Bye
                              -- Piya


  কার্ড পড়ে রাজুর ভেতর বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেল। কি করবে, কি বলবে, সে কিছুই বুঝতে পারল না। এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে নিশ্চলভাবে কি যেন ভাবতে লাগলো।

  সুমন আবার বলতে শুরু করলো, - তোর যদি মনে হয় এই কার্ডটিও আমি তোকে ফলস দিলাম, তাহলে তুই নিজে গিয়ে মেয়ের সামনে যাচাই করে আসতে পারিস। আগামীকাল বিকেল চারটের সময় আমার মেয়ে ওর এক দিদির সঙ্গে ধুলাউড়ি হাই স্কুলের সামনে একটি দোকানে কিছু কেনাকাটা করতে যাবে। সেখানে ও তোকে ডেকেছে।..... ইচ্ছে হলে যেতে পারিস...... আর না গেলে তুই কোনদিন আমাকে এসব ব্যাপারে দোষ দিতে পাবিনে। আজকে তোকে মেয়ের কথাটা জানিয়ে দেওয়াই ছিল আমার শেষ কর্তব্য। এরপর থেকে তোরা কি করবি আর কি করবি না সেটা তোদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি আর ওসবের মধ্যে থাকবো না।

  এবার রাজুর নিজেকে বড় অপরাধী বলে মনে হতে লাগলো। কার্ডটি পুড়িয়ে সেতো মস্ত বড় ভুল করেইছে, তার সঙ্গে সুমনকে দোষ দিয়ে সে আরো বড় অপরাধ করে ফেলেছে।
 সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল, আগামীকালকেই সে পিয়ার সঙ্গে দেখা করে আসবে। কিন্তু খালি হাতে যাবে?.... না সে আর একখানা গ্রিটিংস কার্ড লিখবে - নিজের হাতে সে পিয়াকে দিয়ে আসবে। কিন্তু পিয়া তা নেবে তো? যদি কার্ড পুড়িয়ে ফেলার কথা শুনে পিয়া তার উপর রেগে থাকে?
 অপরাধীর মতো সুমনকে প্রশ্ন করল, - আমি যদি আর একটি কার্ড লিখে পিয়াকে দিই তাহলে ও নেবে তো?
  -- আমি তা বলতে পারব না। তবে না নেওয়ার তো কোন কারণ দেখছি না!  ইচ্ছে হলে সে অবশ্যই নেবে। তবে হ্যাঁ, এটা খেয়াল রাখিস যে ওর সঙ্গে ওর এক দিদি থাকবে। গ্রিটিংস-এ এমন কিছু লিখিস না যাতে ওর দিদি খারাপ কিছু ভেবে বসে থাকে। এর আগের গ্রিটিংস-এ তুই 'লাভ' চিহ্ন এঁকেছিলি, সেটা আর না হয় না-ই আঁকলি।
  -- ওর দিদি সঙ্গে থাকলে কিভাবে ওকে কথা বলব?
  -- কোন ব্যাপার নেই। ওর দিদি ভীষণ ফ্রি - কিছুই মনে করবে না। তুই হয়তো জানিস না যে ওরা নিজেদের মধ্যে বন্ধুর মতো সমস্ত কিছুই আলোচনা করে। সুতরাং তুই নিশ্চিন্তে পিয়ার সঙ্গে গল্প করতে পারিস।

  পিয়ার দিদির কথা মাথায় রেখে রাজু বাজার থেকে একখানা 'লাভ' চিহ্ন বর্জিত সিম্পল গ্রিটিংস কিনে আনলো। আগের কবিতাটি বহু যত্নে নকশা করে এই কার্ডে লিখে ফেলল - তবে কবিতার মধ্যে আগে যেখানে 'লাভ' চিহ্ন ফুটে উঠেছিল  সেখানে এবার ফুটে উঠলো একটি ফুলের নকশা।

  ধুলাউড়ি হাই স্কুলের সামনে মাঠের পাশে একটি আমগাছের নিচে রাজু দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, চারটে বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। ঠিক চারটের সময় পিয়ার পৌঁছে যাওয়ার কথা। আর মাত্র পাঁচ মিনিট...... তারপরেই পিয়ার সঙ্গে তার দেখা হবে...... পিয়ার সঙ্গে সে কথা বলবে....... এই প্রথম..... তার এতদিনের স্বপ্নের রানী আজ প্রথম বাস্তব পৃথিবীতে নেমে এসে তাকে সরাসরি কথা বলবে......... কি বলবে তাকে প্রথমে?..... সে-ই বা কি উত্তর দেবে?...... তার সামনে সে কথা বলতে পারবে তো?......... যদি তার কথাগুলি আটকে আটকে যায়?....... ভাবতেই রাজুর হৃৎস্পন্দন এক লাফে সপ্তমে চড়ে গেল। সে বুকে হাত দিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। যতই সে পিয়ার সামনাসামনি হবার কথা ভাবতে লাগলো ততই তার মনের ধুকপুকুনি বেড়ে যেতে থাকলো।
 এমন সময় পেছন থেকে আওয়াজ ভেসে এলো,- আরে রাজু, তুই এখানে একা একা দাঁড়িয়ে কি করছিস?

  চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো তার এক বহু পুরাতন বন্ধু তার দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। দুই বন্ধুতে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল। ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে রাজু নিজেকে কিছুটা হালকা করে ফেলল। কিন্তু পাশাপাশি তার মনে আশঙ্কা জমতে শুরু করল, পিয়ার সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে এই ছেলেটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে না তো? ছেলেটির সামনে যদি পিয়া তাকে লজ্জায় কথা না বলতে পারে?... যে করেই হোক ছেলেটিকে তার কাছ থেকে দূরে সরানো উচিত।
 
  কিন্তু তাকে দূরে সরাবে কিভাবে? যেভাবে তার সঙ্গে সে জমিয়ে গল্প শুরু করেছে তাতে ছেলেটির এখনই বিদায় নেওয়ার কোনো লক্ষণই সে দেখতে পেল না। এবার তার চোখ গেল রাস্তার উপর - হঠাৎ করে আবার তার হৃদপিণ্ডটা কেঁপে উঠলো - পিয়া আসছে। সঙ্গে তার আরও দুজন । ওরা তিনজন এগিয়ে আসছে।
 এবার রাজু কি করবে? তার  মস্তিষ্কের সমস্ত চিন্তাশক্তিই যেন ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে গেল। সে তার বন্ধুর সঙ্গে এবার বেশি বেশি করে কথা বলার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু পারল না। তার কথাগুলি মাঝে মাঝে আটকে যেতে লাগল। তার অসংলগ্ন কথা শুনে বন্ধুটি কিছুটা অবাক হলো, কিন্তু কিছু বলল না।
 ওরা তিনজন এগিয়ে আসছে ...... কিন্তু তাদের কাছে এলো না। পিয়া একবার রাজুর দিকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। 

  পিয়া একটা কালো রংয়ের সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে। রাতের অন্ধকার কে ছিন্নভিন্ন করে যেমন চাঁদের আলো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি ভাবে পিয়ার মুক্তোর মত শরীরের রং কালো পোশাক কে ছিন্নভিন্ন করে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে।

  এবার পিয়া একটি টিউবয়েলের কাছে গিয়ে হাতমুখ ধুতে শুরু করল। রাজু অপলক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো পিয়ার মুখ ধোয়া, হাত ধোয়া, পা ধোয়া প্রভৃতি ক্রিয়াকান্ডগুলি । দেখতে দেখতে তার মনে হলো, একি পৃথিবীর কোন বাসিন্দা?.... নাকি আকাশ থেকে ছিটকে আসা কোন স্বর্গের অপ্সরা.... এই সেই পিয়া যার সঙ্গে অন্য কারো কোনোভাবেই তুলনা চলে না।
 সে কি তাকে কথা বলবে? সত্যই কি আজ তাকে সে এখানে দেখা করতে ডেকেছে? কিন্তু কই পিয়া তো তার দিকে আপন জনের মতো একবারও তাকালো না। তার দৃষ্টিতে যেন কেমন একটা পরপর ভাব। তাছাড়া একটু আগেই তো পিয়া তাকে পাস কাটিয়ে চলে গেল - কিন্তু কই তার কাছে তো এলো না..... কিংবা তার দিকে তাকিয়ে একবারও একটু মুচকি হাসলো না?

  এখন সে কি করবে? সে কি নিজে গিয়ে পিয়াকে কথা বলে আসবে? কিন্তু তার পক্ষে তো তা সম্ভব নয়‌। সুতরাং আজকে হাল ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
 পিয়ার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বেশ জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সে তার বন্ধুর সঙ্গে ধীরে ধীরে গল্প করতে শুরু করল। ওরা তিনজন এবার তাদের সামনে দিয়ে একটি কসমেটিকসের দোকানে ঢুকে গেল।

  কিছুক্ষণ পর রাজুর বন্ধুটি রাজুকে বলল, - তুই তাহলে থাক। আমার একটু কাজ আছে। আবার তোর সঙ্গে পরে দেখা হলে কথা হবে।

  রাজু একা দাঁড়িয়ে আছে হাই স্কুল মাঠের পাশে একটি আম গাছের নিচে। এবার ওরা তিনজন দোকান থেকে বেরিয়ে এলো‌। রাজুর ভেতরে এবার ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল .... ওরা তিনজন তার দিকেই এগিয়ে আসছে.... হাসিমুখে।
  -- ভালো আছো?
  প্রথম আওয়াজটি শুনতে পেল রাজু তার স্বপ্নের রানীর হাসিমাখা মুখ থেকে। তার মনে হল যেন তার শরীরটা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। কোনমতে জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে সে জবাব দিল, - হ্যাঁ আছি, মোটামুটি ভালো।

 পিয়ার মুখের হাসি কিন্তু স্বাভাবিক; তার কথাবার্তাও স্বাভাবিক।
  -- তোমার সঙ্গে যে ছেলেটি দাঁড়িয়েছিল সেটা তোমার কে?
  -- ও এমনি.... মানে আমার বন্ধু।
  -- তোমার এবার ঈদ কেমন কাটলো?
  -- মোটামুটি।
  -- আমার ঈদ এবার কিন্তু দারুণ কেটেছে। এই যে এটা হচ্ছে আমার কাকার মেয়ে। এর বাবা কলকাতায় চাকরি করে। তাই এরা সব সময়ই কলকাতায় থাকে। এবার ঈদে আমাদের বাড়ি এসেছে। তাই আমরা এবার একসঙ্গে দারুন এনজয় করলাম। খুব হইহুল্লোড় করে কাটালাম এই ক'দিন।.........

  তন্ময় হয়ে রাজু পিয়ার কথা শুনতে লাগল। তার হাসির ঝংকার, কথার সুর, হাত নাড়াবার ভঙ্গি - এ সমস্তর মধ্যে যেন সে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। তার মনে হতে লাগলো যেন সে স্বপ্ন জগতের কোন এক রঙিন রাজ্যে পরীদের রাজকন্যার সাথে হাসি ঠাট্টায় মেতে আছে। সে নিজে থেকে কিছুই বলতে পারছে না..... তার মুখ থেকে কোন কথাই বেরোচ্ছে না.... আজ যেন সে পিয়ার কাছ থেকে শুধু শুনতেই এসেছে। তার কিছুই বলার নেই। অথচ বলার জন্য কত কথাই না তার মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে... কিন্তু তারা কোন মতেই ঠোঁটের প্রান্ত পর্যন্ত আসার সাহস পাচ্ছে না।

  রাজু কে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পিয়া আবার প্রশ্ন করল, - ভালো করে পড়াশোনা করছো তো? খুব ভালোভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর।

  এবার রাজু যেন বলার জন্য মস্ত বড় একটা কথা পেয়ে গেল। সেও সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে জবাব দিল, - তুমিও ভালো করে পড়াশোনা করো।
  কিন্তু যাহ্.... গেল কোথায় সব কথাগুলি?...... এবার সে কি বলবে?....... আরে ছিঃ ছিঃ ছিঃ এতক্ষণ সে আসল কথাটাই ভুলে গিয়েছিল। গ্রিটিংসটা তো প্রিয়াকে এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি? সুতরাং মনের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে কথা না বের করে সে দ্রুত তার সাইকেলের কাছে গিয়ে ব্যাগ থেকে একখানা খাতা বের করে পিয়ার কাছে নিয়ে এলো। কোন রকম ভূমিকা না করেই পিয়ার দিকে খাতাটি এগিয়ে ধরল।
 পিয়া একটু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, কার খাতা?
 তারপর খাতার পাতা উল্টে দেখল ভেতরে একখানা গ্রিটিংস কার্ড। কার্ডটি হাতে নিয়ে রাজুকে খাতাটি ফিরিয়ে দিল।

  পিয়া কার্ডটি খুলে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো.... আর ধীরে ধীরে তার মুখের হাসি যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। তার ঠোঁটের প্রান্ত থেকে এতক্ষণ যে কথাগুলি ঝর্ণাধারার মতো স্নিগ্ধ গতিতে প্রবাহিত হচ্ছিল, তা যেন হঠাৎ থমকে গেল। কার্ডটি তার বোনের হাতে ধরিয়ে উদাস হয়ে ঠোঁটে হাত দিয়ে কি যেন ভাবতে লাগলো।

  পিয়াও চুপ। রাজুও চুপ। দুজনেই চুপ। কিছুক্ষণ পর রাজু ভাবলো এবার পিয়ার সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। এতক্ষণ পর্যন্ত তাকে তো কিছুই বলা হয়নি। সে পিয়াকে কি কি বলবে তার একটি সূচি মনে মনে তৈরি করে ফেলল। তারপর সাহসে ভর দিয়ে সেগুলি বলার জন্য মুখ খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। পিয়া সেই তখন চুপ করে গেছে তারপর আর একটি কথাও বলেনি।

  রাজু বারবার তাকে কথা বলার চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু পারল না। সময় কিন্তু নিজের গতিতে বয়ে চলেছে। কারো দুর্বলতার প্রতি দয়া দাক্ষিণ্য দেখানোর অবসর তার নেই। পিয়ার দিদি পিয়াকে বলল, - চল এবার বাড়ি। আর তো কোন কাজ নেই। 
 ওরা তিনজনে চলে যেতে উদ্যত হলো। রাজুর মনটা হঠাৎ যেন ছ্যাঁৎ করে উঠলো। তার মনের সমস্ত কথাগুলি তালগোল পাকিয়ে গেল। সে এবার সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করল 'আবার কবে দেখা হবে' ।  কিন্তু হায়রে লজ্জা! এবারও সে ব্যর্থ হল।

  পিয়া বাড়ি ফেরার মুহূর্তে রাজুকে বলল, - তুমি এখন বাড়ি যাবে না?
  -- হ্যাঁ, মানে ইয়ে, কিছুক্ষণ পরে যাব।
  -- তাহলে তুমি থাকো, আমরা আসি।
  -- হ্যাঁ এসো।

ওরা তিনজন চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল। রাজুর মনের মধ্যে আর্তনাদ করে উঠলো  'আবার কবে দেখা হবে'।
 ওদের মধ্যে একজন একবার পিছন ফিরে তার দিকে তাকালো। কিন্তু পিয়া একবারও পিছন ফিরে তাকালো না। রাজু তাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তার মনের মধ্যে গুমরে গুমরে উঠে নিস্তেজ হয়ে গেল - 'আবার কবে দেখা হবে' ।






ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ





  -- কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি সুমন, তুই কিন্তু আমাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিস। এই ক'দিন থেকে তুই আমাকে পিয়ার কথা কিছুই বলিস নি। আমার গ্রিটিংস পাওয়ার পর পিয়া তোকে কি কি বলল অন্তত তার কিছু তো আমাকে শোনাবি?
  -- পিয়া তোর কথা আমাকে কিছু না বললে আমি কোথা থেকে ওর কথা তোকে শোনাবো? আমার সঙ্গে দেখা হলে ও মোটেও তোর কথা জিজ্ঞেস করে না। আমি নিজেই তো অবাক হয়ে যাচ্ছি ভেবে, যে মেয়েটি তোর কথা শোনার জন্য আমার বাড়ি পর্যন্ত চলে যেত, সেই মেয়েটি এখন কেন তোর কথা আর আমাকে জিজ্ঞেস করে না। আচ্ছা, তুই কি গ্রিটিংসে  এমন কিছু লিখেছিলি যা পড়ে ওর তোর ওপর কোনরকম রাগ টাগ হতে পারে?
  -- আমি তো তোকে গ্রিটিংসটা দেখিয়েছিলাম। তুই তো নিজের চোখে সব দেখেছিস। তবে হ্যাঁ, তোকে না জানিয়ে গ্রিটিংসের খামের মধ্যে একটা ছোট চিঠি লিখে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। তবে তাতে এমন কিছুই লেখা ছিল না। ও যে আমাকে ওর কার্ডে 'আপনি' বলে সম্বোধন করেছিল - আমি চিঠিতে লিখেছিলাম যে ও যেন আর আমাকে 'আপনি' না বলে 'তুমি' বলে ডাকে। আরও দু'একটি কথা অবশ্য লিখেছিলাম - তবে তার মধ্যে এতোটুকুও প্রেম সম্পর্কিত কিংবা অন্য কিছু খারাপ মন্তব্য ছিল না। আমি তো খুব সাবধানে লিখেছিলাম শুধুমাত্র ওর দিদির কথা ভেবে।
  -- তুই যেভাবেই লিখিস না কেন তুই চিঠিটা দিয়ে খুব ভুল করেছিস। এমনও হতে পারে তোর চিঠি পড়ে ওর তোকে পছন্দ হয়নি। আর তাছাড়া চিঠি দিলে আগে থেকে তো তুই আমাকে জানাতে পারতিস?
  -- দেখ ভাই, আমি ভাবতেই পারিনি যে আমি চিঠি লিখব। খামের মধ্যে গ্রিটিংস ঢোকানোর মুহূর্তে হঠাৎ করে আমার মনে হলো যে ওকে আমার দু' একটি কথা বলা উচিত। তাই তখন তাড়াতাড়ি লিখে ফেললাম - এত তাড়াতাড়ি লিখেছিলাম যে আমার হাতের লেখা খুব একটা ভালো হয়নি। আমি নিজেই তো চিঠি দিয়ে খুব পস্তাচ্ছি। আমি এখন কি করবো বল্?
  -- গতকাল আমি নিজে থেকেই মেয়ের সামনে তোর কথা তুললাম । ওর কথা শুনে একটা কথাই বুঝতে পারলাম যে, ও ভেবেছে তুই ওকে সেরকম ভাবে ভালোবাসিস না। তোর মধ্যে ও কোনরকম প্রেমের লক্ষণ খুঁজে পাইনি। ও ভেবেছে তুই হয়তো ওকে বন্ধুর মতো দেখিস। তোর গ্রিটিংস এর মধ্যে ও কোনো রকম প্রেমের চিহ্ন খুঁজে পায়নি। আর তাছাড়া তুই ওকে সেদিন কথাই বলতে পারিস নি। আর তাতেই হয়তো ও তোকে ভুল বুঝেছে।
  -- তোর কথা শুনেই তো আমি ওকে সিম্পল গ্রিটিংস দিলাম। আর সেদিন আমি ওকে এতবার কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মনে হল কে যেন আমার গলা টিপে ধরেছে - একটা কথাও বলতে পারলাম না। এবার আমি কি করবো বল্ । আমি যেদিকেই যাচ্ছি সেদিকেই আমার বিপদ। তুই দয়া করে ওকে আমার সম্বন্ধে সবকিছু খুলে বলে একটু বোঝাস না যে, আমি ওকে প্রচন্ড ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে যাবে রে!
  -- তুই কি ভাবছিস আমি ওকে কিছুই বোঝাইনি? আমি অনেক বুঝিয়েছি। আমার কথা কিছুই বিশ্বাস করেনি। সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে ও অত্যন্ত জেদি মেয়ে - নিজে যেটা বোঝে সেটাই ও বিশ্বাস করে - অন্যের কথায় ও বিন্দুমাত্র ভরসা করে না।
  -- এখন আমি ওকে কিভাবে বোঝাই যে আমি ওকে কত ভালোবাসি? ও যদি একবার আমাকে হাসতে হাসতে ইয়ার্কি করেও বলতো "রাজু আমাকে তোমার একটা আঙ্গুল কেটে দাও তো দেখি" তাহলে আমি সঙ্গে সঙ্গে এতোটুকুও না ভেবে এক কোপে আমার আঙ্গুলটা কেটে ওকে নিজের হাতে ধরিয়ে দিতাম। আমার জীবনটা চাইলেও ওকে সেটা দিয়ে দিতে আমার এতটুকু দ্বিধা হবে না।

  সুমন রাজুর কথা শুনে হেসে ফেলল। তারপর বলল, - যত সব পাগলামি কথা!
  -- তুই হাসছিস? হ্যাঁ, হাসি তো তোর পাবেই। তুই তো আমার মত কাউকে ভালবাসিস নি। তোর প্রেম ওপর ওপর ভাসা ভাসা -  কোন গাঢ়ত্ব নেই । আমার আঙ্গুল কাটার কথা শুনে তোর হাসি পাচ্ছে? ভাবছিস সব মিথ্যে? পিয়া যদি আমার সামনে না এসেও তোকে দিয়ে আমার আঙ্গুলটা চেয়ে পাঠায়, তাহলেও আমি তোকে সঙ্গে সঙ্গে আমার আঙ্গুল কেটে দিয়ে দেবো। কালকে গিয়ে তুই জিজ্ঞেস করিস পিয়াকে ও আমার আঙ্গুল নেবে কিনা?
  -- তুই একটা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছিস। একটা সামান্য মেয়েকে নিয়ে এত ভাবার কি আছে? পৃথিবীতে কি আর কোন মেয়ে নেই? পিয়াই কি সব? তুই ওর মধ্যে এমন কি পেয়েছিস যে এভাবে মজে গেছিস? এতে ওর ক্ষতি, না তোর ক্ষতি? ও তো দিব্যি সুন্দর বহাল তরিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোর মত তো ভেঙ্গে পড়েনি। ছি ছি ছি,আমি তো ভাবতেও পারিনি তুই পিয়াকে এত ভালবেসে ফেলবি। জানলে আমি ওর কথা তোকে কিছুই বলতাম না।...... ওসব পিয়া টিয়ার কথা ভুলে এখন নিজের পড়াশোনায় মন দে। ভাগ্যে থাকলে ওর কথা না চিন্তা করেও তুই ওকে পাবি। আর ভাগ্যে না থাকলে ওর কথা ভেবে ভেবে তুই যদি মরেও যাস তবুও ওকে পাবিনে। এখন একটু নিজের জীবনের কথা মাথায় রেখে একটু পড়াশোনা কর।

  রাজু সুমনের কথার কোন উত্তর দিতে পারল না। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।


  সেদিন বিকেল বেলা আড্ডার ফাঁকে রাজু যখন তার এক বন্ধুর কাছে শুনতে পেল, পিয়ার বিয়ে এক হাই স্কুল মাস্টারের সঙ্গে ঠিক হয়ে গেছে, তখন তার মনের মধ্যে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। সংবাদদাতা বন্ধুটিকে সে জিজ্ঞেস করল, - তুই কিভাবে জানলি যে পিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?
  বন্ধুটি হাত নেড়ে জবাব দিল, - বারে, আমি জানবো না? শুধু আমি কেন, এটা সবাই জানে। এই গতকালকেই একটা দোকানে বসে পিয়ার বাবা ওর এক বন্ধুর সঙ্গে পিয়ার বিয়ের কথাই আলোচনা করছিল। আমি দোকানে মাল নিতে নিতে নিজের কানে সব শুনলাম। আমি তো এটাও শুনেছি যে স্কুল মাস্টার টি নাকি এখন থেকেই পিয়াকে বই, খাতা, পরীক্ষার সাজেশন আর দামি দামি উপহার দিয়ে পিয়ার মন জয় করতে শুরু করে দিয়েছে। বড়লোকের ছেলে, দেখতেও বেশ সুন্দর - এমন ছেলেকে পিয়াও খুব সহজে পছন্দ করে ফেলেছে।

  রাজু সামনের আম গাছের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে লাগলো। তার মুখ থেকে আর একটি কথাও বেরোলো না। ধীরে ধীরে তার চোখ দুটি ছল ছল করে উঠলো। কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে সে সেখান থেকে উঠে চলে গেল।


  পরদিন সুমনকে সে জিজ্ঞেস করল, - একটা কথা সত্য করে বল তো সুমন - পিয়ার কি কারো সঙ্গে বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে?
  কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুমন জবাব দিল, - ওর বিয়ে ঠিক হোক আর না হোক তাতে তোর কি? আমি তো আগেই তোকে বলেছি ওর কথা ভুলে যা। যে মেয়েটি খুব সহজেই তোর কথা ভুলে গেল তার বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে তোর কি লাভ?
  -- এরপর থেকে আমি আর তোকে ওর কথা কিছুই জিজ্ঞেস করবো না। আজকে শুধু এটুকুই আমাকে বলে যা সত্য সত্যই কি পিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?
  -- আমি নিজে এখন পর্যন্ত খুব বেশি কিছু জানিনা। তবে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের মুখ থেকে তো তা-ই শুনছি। ছেলেটা নাকি এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে মাস্টারি চাকরি পেয়েছে। ওদের অবস্থাও খুব ভালো। বিয়ের কথাবার্তা সমস্তই নাকি পাকা হয়ে গেছে।
  -- আমি এখন বুঝতে পারছি, পিয়া কেন আমাকে এড়িয়ে চলছে। কেন ওদের বাড়ির সামনে দেখা হলেও ও আমাকে কথা বলল না।......  আর তো আমাকে কথা বলবেই না........ বলবেই বা কেন....... আমি তো আর হাই স্কুলের মাস্টার নই.... আমি তো আর মাসে মাসে বেতন পাই না..... আমি তো আর বড়লোকের একমাত্র ছেলে নই...... পিয়া এখন কথা বলবে বড়লোকের সঙ্গে।...... আমি কে?..... আমি তো একটা ভিখারির ছেলে।......  আমি তো আর পিয়ার প্রয়োজন মেটাতে পারবো না।...... তাহলে পিয়া আসবে কেন আমার কাছে? ও তো আর বোকা মেয়ে নয় যে আমার মত এক ছন্নছাড়া বেকারের কাছে এসে ধর্না দেবে? ও ঠিকই করেছে; ওর জীবনের পক্ষে উপযুক্ত একজনকে ও বেছে নিয়েছে। আশীর্বাদ করি ওরা যেন চিরজীবন সুখী হয়।



  উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। রাজু খুব ভালোভাবেই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। এবার শুরু কলেজে কলেজে ভর্তি হওয়ার পালা। রাজু আশপাশের কোন কলেজে ভর্তি হতে চাইল না। সে পড়তে চায় কলকাতায়। সে পিয়ার জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চায় - পিয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান যেন নিজের চোখে না দেখতে হয়, নিজের কানে না শুনতে হয়। সে কলকাতায় গিয়ে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চায়। আশপাশের আবহাওয়া তার কাছে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। সে যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই যেন জ্বলে উঠছে দাউ দাউ করে আগুন। সে এই যন্ত্রনার মধ্য থেকে মুক্তি পেতে চায়। মুক্তির সন্ধানে সে একদিন তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিয়ে কলকাতা চলে গেল।





সপ্তম পরিচ্ছেদ







বালুটুঙ্গী গ্রাম। এই গ্রামেরই বাসিন্দা রাজু। বাবা ইজাজ সেখ লোহা লক্কড়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ব্যবসা করে প্রথম দিকে তিনি বেশ কিছু পয়সা কামিয়েছিলেন। কিন্তু, অতঃপর.......

  ইজাজ শেখের লোহার দোকানে বিভিন্ন চরিত্রের মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। তাদের মধ্যে একজনের নাম কেল্টু। লোকে তাকে কেল্টুদা বলে ডাকতো। এই লোকটি মানুষের কাছে ঘুরে ঘুরে লটারির টিকিট বিক্রি করতো। ইজাজ শেখ লটারির টিকিট কিনতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন লটারির টিকিট কাটা ভালো জিনিস নয়। কেল্টুদা দোকানে গল্পগুজব করতে আসতো, কিন্তু ইজাজ শেখ এর কাছে লটারি বিক্রির কথা মুখ ফুটে বলতে সাহস পেত না।

  একদিন কেল্টুদা সন্ধ্যা বেলা দোকানে এসে খুব আফসোস করতে শুরু করলো, - আজকে আমার ভীষণ লস হয়ে গেল ইজাজ ভাই। আজকে সারাদিনে মাত্র কয়েকটা টিকিট বিক্রি করতে পেরেছি । এখনো প্রচুর টিকিট আমার ব্যাগে পড়ে আছে । কি করে যে বিক্রি করি কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। এতগুলো টিকিট সব নষ্ট হবে। হাতে আর সময়ও নেই, আগামীকালকেই খেলা । 
  ইজাজ সাহেবও বেচারী কেল্টুদা কে সহানুভূতি জানালেন। 
  সাহস পেয়ে কেলটুদা ইজাজ সাহেবকে প্রস্তাব দিল, - আপনি যদি কয়েকটা টিকিট কিনে নিতেন, তাহলে আমার ভীষণ উপকার হত। আমার কথা শুনে নেন, দেখবেন এই টিকিটগুলো ভীষণ লাকি।

  ইজাজ সাহেব ভালো মানুষ। কারো কথার অবাধ্য হতে পারেন না । তাই আমতা আমতা করে নিজের অসুবিধার কথা জানালেন, - দেখো ভাই, আমি তো আর টিকিট ফিকিট কিনি না। তবুও তুমি যখন বলছ তখন না হয় নিয়েই নিতাম। কিন্তু হাত আজকে আমার একদম খালি। টাকা-পয়সা যা ছিল.........

  কেল্টুদা তড়িৎ গতিতে বাধা দিয়ে বলল, - আরে ছি ছি ছি, টাকার কথা এখন বলছেন কেন? আমি কি আপনার কাছে টাকা চেয়েছি? আপনার যেদিন সুবিধা হবে সেদিন দেবেন, তাতে আমার কোন অসুবিধা নেই।

  ইজাজ সাহেব আর বাধা দিতে পারলেন না। কেল্টুদা-ও মনের সুখে তার হাতে টিকিটের বান্ডিল ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল।

  দুদিন পর কেল্টু দা নিজে এসে ইজাজ সাহেবের টিকিটগুলি মেলাতে শুরু করল। এক সময় আনন্দে লাফ দিয়ে চিৎকার করে উঠলো, - লাকি..... লাকি.... আমি আপনাকে বলেছিলাম না ইজাজ ভাই, এই টিকিটগুলো লাকি ! এই দেখুন আপনি ষাট হাজার টাকা পুরস্কার জিতেছেন।

  ইজাজ সাহেব খুশি হলেন। আনন্দও পেলেন ভীষণ। আর তার সাথে সাথে লটারির প্রতি তার একটা মহব্বতও জন্মে গেল।
  তিনি ভাবলেন লটারিতেই বুঝি তার ভাগ্য খুলে যাবে। সুতরাং পুরস্কারের টাকা নিয়ে তিনি আবারও কিনলেন লটারির টিকিট। এবারও তিনি পেলেন কয়েকশো টাকা। ইজাজ সাহেব লটারির টিকিট কিনতে শুরু করে দিলেন। এখন নিয়মিত কেল্টুদা তার কাছে টিকিট বিক্রি করে যায়। আরো কয়েকজন টিকিট বিক্রেতা তার কাছে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করে দিল। তারা সবাই স্বপ্ন দেখায়....  তিনিও স্বপ্ন দেখেন..... স্বপ্নের ঘোরে তিনি টিকিট কিনে চলেন। কিন্তু এখন আর তিনি লটারিতে সেভাবে টাকা বাধাতে পারেন না। তিনি যে টাকা পান তার থেকে বেশি টাকা তার পকেট থেকে বেরিয়ে যায়।
  তবুও তিনি আশা ত্যাগ করেন না। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, একবার না একবার তিনি মোটা অংকের টাকা পেয়ে যাবেন। তখন তার পকেটের ঘাটতি তিনি পুষিয়ে নেবেন...... কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণ হয় না। দিন চলে যায়..... তার পকেট শূন্য হতে থাকে... দোকানের মালপত্র শূন্য হতে থাকে..... সংসারে দেখা দেয় অভাব অনটন। বাড়িতে গিন্নি আর তিন সন্তানের প্রয়োজন সেভাবে মেটেনা। ফলে শুরু হয় অশান্তি।

  রাজু কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করে। সেখানে থাকার খরচটাও একটু বেশি। তার খরচ যোগানো ইজাজ সাহেবের পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনা। অনেক কষ্টে ম্যানেজ করে মা-ই রাজুকে টাকা পাঠাতে থাকেন। কিন্তু একসময় তার পক্ষেও তা অসম্ভব হয়ে ওঠে । ইতিমধ্যে রাজু একদিন বাড়ি ফিরল। তাকে সাংসারিক দুরবস্থার কথা তিনি বুঝিয়ে বললেন। তারপর বললেন, - আশেপাশে তাকিয়ে দেখ রাজু, বাড়িতে থেকেও অনেকে কলেজে পড়াশোনা করে। এইতো জিয়াগঞ্জ লালবাগ যাতায়াত করেও তো তারা দিব্যি সুন্দর রেজাল্ট করছে। তুইও যদি বাড়িতে থেকে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাস।
  -- কিন্তু মা, আমার যে একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে?
  -- এছাড়া আর উপায় কি বল্ ? আমরা কি চাইনি যে তুই কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করিস? তাছাড়া তোকেও তো একটু সংসারের কথা ভাবতে হবে। তুই নিজেই ভেবে দেখ, তোকে আমি কোথা থেকে টাকা দেব?..... এখন তো সংসারই ভালো মতো চলে না।
  -- থাক থাক, আমার কথা আর তোমাদের ভাবতে হবে না। আমি না পড়লেই তো তোমরা শান্তি পাবে?

  রাজু উঠে চলে যাচ্ছে দেখে মা তাকে বাধা দিতে গেলেন, - এই রাজু, শোন্ বাপ আমার..... তুই না হয় জিয়াগঞ্জে একবার খোঁজ নিয়ে আয় বাবা...... এই রাজু, রাগ করিস নারে....

  রাজু মায়ের কথার কোন উত্তর না দিয়ে সেখান থেকে হনহন করে চলে গেল।




অষ্টম পরিচ্ছেদ





জিয়াগঞ্জ শ্রীপৎসিং কলেজ । কলেজের ভেতর একপাশে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজু।
  -- রাজু তুমি?.... এখানে?

  চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, পিয়া। তার দুজন বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অপ্রত্যাশিত সাক্ষাতে রাজু হতভম্ব হয়ে গেল। সে কিছুক্ষণ পিয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। 
  পিয়া হাসতে হাসতে আবার জিজ্ঞেস করল, - কি ব্যাপার, একা একা দাঁড়িয়ে আছো?
  -- হ্যাঁ... মানে.... কলেজে ভর্তি হবো তো তাই দাঁড়িয়ে আছি।
  পিয়া আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, - কেন, তুমি যে কলকাতায় ভর্তি হয়েছিলে?
  -- হয়েছিলাম। এক বছর ক্লাসও করেছি। কিন্তু একটা অসুবিধার জন্য ওখানে আর থাকা হলো না। এখন ভাবছি বাড়িতে থেকে পড়বো। তাই এখানে এসেছি ভর্তি হবার জন্য।
  -- কোন সাবজেক্ট নিয়ে ভর্তি হবে?
  -- কোন সাবজেক্ট ? - রাজু মাথা নিচু করে জবাব দিল, - কোন সাবজেক্ট নয়, এমনি পাস কোর্সে ভর্তি হব।
  -- ভালই হল এবার আমরা একই কলেজে পড়বো।
  -- তুমিও এই কলেজেই ভর্তি হয়েছো?
  -- হ্যাঁ । এই কয়েকদিন হল ভর্তি হয়েছি। আজকে প্রথম ক্লাস করব । 
  -- তোমার কি সাবজেক্ট ?
  --বাংলা অনার্স ।তুমিও তো অনার্স নিয়ে ভর্তি হতে পারতে? উচ্চমাধ্যমিকে তো তোমার ভালোই নম্বর ছিল।
  -- হয়তো পারতাম । কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন তো আর অনার্স পাওয়া যাবে না ! আমি আসলে এখানে ভর্তি হবার জন্য প্রথমে কোন ফর্ম-ই তুলিনি। এখানে ভর্তি হবার কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না। কিন্তু অনেকটা বাধ্য হয়েই ভর্তি হচ্ছি। কলকাতা থেকে একটা অসুবিধা জন্য চলে এসেছি। আর সেজন্যই শুধু শুধু একটা বছর আমার নষ্ট হয়ে গেল।

  কলেজের ইউনিয়ন রুম থেকে একটি ছেলে বেরিয়ে এসে হাঁক ছাড়লো, - রাজু কার নাম? নতুন ভর্তি হবে?.... সঞ্জয়দার সঙ্গে সোজা অফিস ঘরে চলে যাও। মার্কসিট দেখিয়ে ওখানেই ভর্তি হবে।

  রাজু পিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, - তাহলে তুমি গিয়ে ক্লাস কর। আমি ভর্তিটা হয়ে আসি। তারপর আবার দেখা হবে।

  হালকা বাতাসে ভাসতে ভাসতে চলল রাজু সঞ্জয় দার সঙ্গে। বহুদিন পর তার হৃদয়ের মধ্যে আজ স্বর্গীয় স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে গেল। আজকে হঠাৎ করে তার মনের সেই দরজাটি খুলে গেল যা প্রায় এক বছর পূর্বে সুতীব্র কর্কশ শব্দে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । সেই খোলা দরজার পাল্লা ঠেলে আজ হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল তার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন জগৎ।

  রাজু কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। ক্লাসও করল একটা। কিন্তু তার চোখ দুটি শুধুই জানালার ফাঁক দিয়ে ক্লাসের বাইরে তার চিরকাঙ্ক্ষীতের সন্ধানে ব্যস্ত থাকলো। প্রফেসরের লেকচার গুলি তার কানের মধ্যে ঢুকলো বটে কিন্তু মস্তিষ্কে স্থান পেল না। সেখানে স্থান দখল করে বসে আছে আর একজন - পিয়া।


  ক্লাস শেষ হয়ে গেল। রাজু আর পিয়া দুজনে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে স্টেশন এর দিকে। ওরা বাড়ি ফিরবে ট্রেনে। ট্রেনের সময় প্রায় হতে চলল। ট্রেন ধরতে হলে ওদের খুব দ্রুত স্টেশন পৌঁছাতে হবে। কিন্তু ওরা হাঁটছে খুব ধীরে ধীরে। পিয়ার সঙ্গে যে দুজন বান্ধবী ছিল তাদের একজন পিয়াকে একটু গুঁতো দিয়ে বলল, - কিরে, এভাবে কচ্ছপের মতো হেঁটে গেলে তো স্টেশন পৌঁছাতে একমাস লেগে যাবে। তোর কি ট্রেন ধরার ইচ্ছা নেই?
  পিয়া একটু ঝাঁঝিয়ে উঠে জবাব দিল, - পৃথিবীতে কি তোদের ওই একটাই ট্রেন আছে? আর কি কোন ট্রেন নেই? এটায় না হবে পরের ট্রেনে যাওয়া যাবে। অত তাড়াহুড়ো কিসের?
  -- ও - ও - ও তা-ই বল্ । কথাটা একটু আগে বললেই পারতিস । তোদের সঙ্গে সঙ্গে আসতাম না। এতক্ষণ হয়তো স্টেশন পৌঁছেই যেতাম।  - বলেই দুজন বান্ধবী দ্রুত হেঁটে ওদের আগে চলে গেল।

রাজু একটু লজ্জিত হয়ে পিয়াকে জিজ্ঞেস করল, - ওদেরকে একা ছেড়ে দিলে; একসঙ্গে গেলেই তো পারতে? হয়তো ওরা তোমার উপর রাগ করবে।
  পিয়া রাজুর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল, - ওরা আমার উপর রাগ করে না, তেজ দেখায়। আর তুমিই বলো, আমি ওদের একা ছেড়ে দিলাম, না ওরাই আমায় একা ছেড়ে পালিয়ে গেল?
  রাজু এবার মাথা চুলকে নিচু দিকে মুখ করে বলল, - না, মানে তোমরা একই সঙ্গে কলেজে এসেছো তো !
  -- একইসঙ্গে কলেজ এলে একইসঙ্গে বাড়ি ফিরতে হয় বুঝি? তার মানে তুমি বলতে চাইছো যে আমি ওদের সঙ্গে এসেছি বলে আমাকে ওদের সঙ্গেই বাড়ি ফেলা উচিত ; আর তুমি একা এসেছো বলে তোমাকে একা একাই বাড়ি ফেরা উচিত। তাই তো?

  এবার রাজু ভীষণ লজ্জা পেয়ে হাত নেড়ে দ্রুত প্রতিবাদ করতে গেল, -  না- না- না- না, তুমি আসলে ভুল বুঝছো । আমি মোটেও সেরকম বলতে চাইনি। আমি যেটা বলতে চাইছি সেটা হচ্ছে........ মানে....... সেটা হচ্ছে..... মানে আর কি........... এই যে তুমি আর আমি.......
  এরপর রাজু আর কিছুই বলতে পারল না। মস্ত বড় অপরাধীর মতো লজ্জায় চোখ মুখ লাল করে নিয়ে একবার পিয়ার মুখের দিকে আর একবার নিচে রাস্তার দিকে তাকাতে শুরু করল।
  বেচারা রাজু! সে কি বলতে চায় সে নিজেও হয়তো জানে না। কিন্তু তার করুন অবস্থা দেখে পিয়া ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর হাসতে হাসতে বলল, - তুমি এখনো সেই ছোট ছেলে হয়েই থেকে গেলে। এই জন্যই তোমাকে আমার এত ভালো লাগে। তোমার প্রতিটি আচরণ-ই শিশুদের মত। সেই প্রথম থেকেই দেখে আসছি।

  কথাটা সত্য। তার থেকেও বেশি আনন্দের । এই কয়েকটি মাত্র শব্দ । এর মধ্যে এমন কি জাদু শক্তি আছে, যা অশান্ত সাগরকে শান্ত করে দিতে পারে? যা আকাশ পাতালকে একাকার করে দিতে পারে? এই কয়েকটি শব্দ, এর মধ্যে কি অপার স্নেহ-মমতা লুকিয়ে আছে, যার প্রভাবে রাজুর মনের সমস্ত অস্থিরতা আর লজ্জা মুহূর্তের মধ্যে উড়ে যায়? মুহূর্তের মধ্যে তার থেকে পিয়ার সমস্ত দূরত্ব মুছে গিয়ে তাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সবথেকে আপন বলে মনে হতে থাকে? আর আপন জনকেই তো মনের সমস্ত কথা খুলে বলা যায়। রাজুর সমস্ত শরীর মন হালকা হয়ে গেল। সে এখন স্বাভাবিক। সে এখন সমস্তই খুলে বলতে পারবে পিয়াকে ।
   কিছুক্ষণ নিচু দিকে মুখ করে থেকে শান্তভাবে পিয়ার দিকে তাকিয়ে এবার রাজু বলল, - তোমার কাছে তো আমি চিরদিনই শিশু হয়ে থাকতে চেয়েছি পিয়া। শিশুর মত তোমার কোলে থেকেই যদি এই জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম..... ধন্য হয়ে যেতাম।

  পিয়ার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রাজুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে বলল, - রাজু, তুমি কলকাতায় ভর্তি হয়েছিলে কেন?
  -- এমনি ভর্তি হয়েছিলাম। ওখানে শহরে থেকে পড়বো বলেই ভর্তি হয়েছিলাম।
  -- না, তুমি আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে বলেই ওখানে ভর্তি হয়েছিলে।
  -- তোমাকে কে বললো?
  -- আমি সুমনের কাছ থেকে শুনেছি। তুমি আমার উপর খুব রাগ করেছো, তাই না?
  -- আমি কার উপর রাগ করব পিয়া? তোমার উপর? তোমার উপর আমার কি অধিকার আছে যে আমি রাগ করবো? আজকে আমরা একসঙ্গে গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছি। কালকে তুমি বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে যেতে পারো। তোমাকে আমি সামান্য টুকুও বাধা দিতে পারবো না।
  -- তুমি আমাকে মস্ত বড় ভুল বুঝেছ রাজু । আসলে দেখো, আমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছাই ছিল না। আমার বাবা-মা নিজেরাই সব ঠিকঠাক করে ফেলেছিল। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে তাদের জানিয়ে দিয়েছি যে আমি এখন কিছুতেই বিয়ে করব না। আগে নিজের পড়াশোনা শেষ করব, তারপর বিয়ের কথা পরে........ আর তুমিই বা কেমন ছেলে? যে-ই না শুনলে আমার বিয়ে হবে আর অমনি ধা করে আমার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলে ! তুমি তো একবার আমার কাছে এসে আমাকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারতে?
  -- আসলে কি জানো ! তোমার কাছে যাওয়ার আমি অনেক চেষ্টা করেছি ; কিন্তু পারিনি । যদি তুমি আমাকে কথা না বল।
  -- এইটাই তোমার দোষ । তুমি কি করে ভাবলে যে আমি তোমাকে কথা বলব না ? তুমি একটা পুরুষ মানুষ । আর আমি একটা মেয়ে । আমি মেয়ে হয়ে তোমাকে আগে কথা বলতে পারি, আর তুমি পুরুষ হয়ে পারো না ? আমি তোমাকে আগে কথা না বললে তো তুমি আমাকে কোন দিন কথাই বলতে পারতে না।
  -- আচ্ছা যাক গে, ছাড়ো ওসব কথা । এখন থেকে তুমি আমাকে ধরে ধরে কথা বলা শিখিয়ে দিও, তাহলেই হবে ।
  -- আমি তোমাকে কথা শেখাতে যাব কোন দুঃখে ? তুমি নিজেই তো মহা পন্ডিত। নিজের মনেই অনেক কিছু ভেবে বসে থাকো, আর সেই মোতাবেক কাজ কর।
  -- আজ থেকে আর একটি কথাও আমি নিজে থেকে ভাববো না পিয়া । আজ থেকে আমার সব দায়িত্ব তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম । তুমি আমাকে যা বলবে আমি তা-ই করবো । এতদিন পর্যন্ত আমি নিজে থেকে ভেবে যে কাজই করেছি তাতেই ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। আসলে কি জানো, আমি পৃথিবীতে বড়ই একা হয়ে পড়েছি পিয়া । আমার মনের কোন কথাই আমি কাউকে বলতে পারি না । পাশে অচেনার ভিড়ে একটা আপনজনকে খুঁজে পেতে চেয়েছি, কিন্তু পাইনি। মাঝে মাঝে স্বপ্নের ঘোরে দেখি কেউ আমায় হাত ছানি দিয়ে ডাকছে। মনে হয় সে-ই পৃথিবীর বুকে আমার সব থেকে আপনজন। মনে হয় তার কাছে ছুটে চলে যায় । সে-ও আমার কাছে আসতে চায় । কিন্তু তা আর হয় না । কারণ স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় । আজকে তোমার সঙ্গে আমি হেঁটে যাচ্ছি পিয়া - এটা তো স্বপ্ন নয়, বাস্তব । কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছে, এটাও একটা স্বপ্ন। স্বপ্নের ঘোরেই আজ আমি আমার সমস্ত দায়িত্ব তোমার হাতে সঁপে দিলাম আমি এই স্বপ্নের কথা কোনদিন ভুলবো না..... কিন্তু তুমি হয়তো কালকেই ভুলে যাবে।

  পিয়া রাজুর কথাগুলি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। এবার তারা স্টেশন এসে পৌঁছালো । পিয়া রাজুর কথার কোন উত্তর দিল না ; শুধু তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,- মুড়ি খাবে? ...... এই যে কাকু, দু'জায়গায় মুড়ি মাখিয়ে দিন তো!

  স্টেশনের শেষ প্রান্ত  সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চে ওরা দুজন গিয়ে বসলো । মুড়ি খেতে খেতে পিয়া রাজুকে প্রশ্ন করল, - তুমি কবিতা লেখ?
  -- হ্যাঁ লিখি টুকটাক । কখনো ইচ্ছে হলে লিখি।
  -- আমাকে একটা কবিতা শোনাবে ?
  -- কিন্তু আমার যে এখন কবিতা মনে নেই ? 
  -- সে কি ? তোমার লেখা কবিতা তোমার মনে নেই ? 
  -- নিজের লেখা কবিতা হলেই কি সব সময় মনে থাকে? দু' এক লাইন হয়তো মনে আছে। বাকিটা না দেখলে বলা যাবে না।
  -- তুমি কি নিয়ে কবিতা লেখ রাজু?

  কিছুক্ষণ আকাশের দিকে উদাস ভাবে তাকিয়ে থেকে রাজু জবাব দিল, - আমার সমস্ত কবিতাই তো তুমি । কবিতা লিখতে বসে আমার কিছুই মনে আসে না....... শুধুই দেখতে পাই তোমারই প্রতিচ্ছবি।
  -- পৃথিবীতে অনেকেই কবিতা তৈরি করে রাজু । অনেক কল্পনা দিয়ে রঙিন করে তোলে সেই কবিতা । কিন্তু একদিন দেখা যায় কোন কোন কবি নিজের হাতেই সেই কবিতাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে কোথায় হারিয়ে যায় । আমার বড্ড ভয় হয়..... স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে..... কিন্তু অবস্থা দেখে আঁতকে উঠিয়ে ভয়ে।

  রাজু কিছু বুঝতে না পেরে পিয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো।
  পিয়া বলে চলল, - আমার একটি বান্ধবী ছিল। সে একটি ছেলেকে ভালোবাসতো। ছেলেটি তাকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল। এমন কথাও বলেছিল ছেলেটি, যে ও যদি আমার বান্ধবীকে না পায় তাহলে আত্মহত্যা করবে। কিন্তু কে জানতো, এ শুধুই কথার কথা। ছেলেটি আর একজনকে ভালোবাসতো ; আমরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি। এই কিছুদিন হলো ছেলেটি আমার বান্ধবীকে চোখের জলে ভাসিয়ে তার সেই প্রেমিকাটিকে বিয়ে করে নিয়েছে । আমার বান্ধবীটি স্বপ্ন দেখেছিল.... রঙিন স্বপ্ন..... আর সেই স্বপ্ন দেখার মূল্য আজ সে দিচ্ছে.... নিজের জীবনের বিনিময়ে।

রাজু অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো ; কিছুই বলতে পারল না। শেষে একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে পিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, - আমি তোমাকে নিয়ে শুধু স্বপ্নই দেখেছি পিয়া। তোমাকে পেয়েছি কবিতার মধ্যে। এই পৃথিবীর রুক্ষ মাটিতে আমি তোমাকে পাবো, সেই দুরাশা আমি করি না। আমি তোমাকে কোনদিনও বলতে পারব না যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে স্বপ্ন দেখানোর মতো সাহস আমার কোথায়? আমি নিজেই স্বপ্ন দেখেছি। আর সেই স্বপ্ন আমি নিজের মধ্যেই রেখে দেবো...... তুমি কোনদিনও জানতে পারবে না।

  এবার পিয়া একটু লজ্জা পেল। রাজুকে বাধা দিয়ে বলল, - তুমি আমার কথা শুনে রাগ করলে? আমি কিন্তু তোমাকে সেরকম কিছু বলতে চাইনি। আমি তোমাকে অন্য ছেলেদের মতো ভাবি না। আসলে কি জানো, মানুষের মন তো!.... বড়ই দুর্বল। আমি কখনো কখনো নিজেই নিজের মনকে ভয় পাই। কেবলই মনে হয় এই পথে যাচ্ছি, শেষে বিপদ হবে না তো? যদি আঘাত পাই, তাহলে সহ্য করতে পারবো তো? কিন্তু ভয় পেয়েও তো নিজের মনকে নিজের আয়ত্তে রাখতে পারলাম না। কখন যে তোমার মাঝে হারিয়ে গেছি নিজেও বুঝতে পারিনি।....... তোমার কথা শুনতে ইচ্ছে করে..... তোমার পাশে বসে থাকতে ইচ্ছে করে...... কিন্তু ভয় হয়, তুমি একদিন আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে না তো?..... আমার জীবন থেকে চলে যাবে নাতো?..... তোমাকে আমি সম্পূর্ণ রূপে পাবো তো? যদি সেভাবে না পাই?......
  বলতে বলতে পিয়া কখন যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে হঠাৎ করে রাজুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, - আরে ছি ছি ছি ছি! আজকে তো কাকি আমাকে আস্ত রাখবে না !

  রাজু হঠাৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পিয়াকে ভয় ভয় জিজ্ঞেস করল, - কেন?
  -- কেন আবার? কাকিমা ওর ছেলের জন্য আমাকে জিয়াগঞ্জ মার্কেট থেকে একটা ভাল দেখে স্কুল ব্যাগ কিনতে বলেছিল। তোমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তো আমি  সে কথা ভুলেই গেছি।
  -- আজকে না হল তো কি হল, কালকে কিনবে?
  -- ওরেব্বাবা, কালকে?...... কিন্তু ব্যাগটা যে আজকেই দরকার ছিল।

  রাজু এবার মুচকি হেসে জবাব দিল, - এই সামান্য একটা স্কুল ব্যাগ! আমি তো ভাবছিলাম, তুমি না জানি কি কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছ। আসলে তুমি ভীষণ চালাক মেয়ে। নিজেকে সব সময় আড়ালে আড়ালে রাখতে চাও। আমার কাছ থেকে সব ভুলিয়েভালিয়ে শুনে নেবে - আর নিজের কথাগুলি এটা ওটা দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করবে।
  -- যা বাবা! আমি কখন আমার কথাগুলো আড়াল করার চেষ্টা করলাম?
  -- এই যে একটু আগেই। তোমার ভালবাসার কথাগুলো সব বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে ফস করে একটা সামান্য কথা তুলে প্রসঙ্গটাই পাল্টে দিলে।

  পিয়া যেন আকাশ থেকে পড়ল, - আমার ভালোবাসা? আমি আবার কাকে ভালোবাসলাম যে আমার ভালোবাসা হবে? এ যে দেখছি তোমার মাথা মুন্ডু সব খারাপ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তোমাকে মেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে না তো?
  -- হুঁঃ ! ডুবে ডুবে জল খাও। এই কান ধরলাম, তোমাকে আর কোনদিন ভালোবাসার কথা বলতে যাব না।

  এবার পিয়া ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর রাজুর হাতখানা ধরে নিয়ে বলল, - থাক থাক, আর কান ধরতে হবে না । ওইদিকে টিউবয়েলের দিকে চলো, একটু জল খেয়ে আসি। ট্রেনের সময় হয়ে গেল। এখনই ট্রেন ঢুকে পড়বে।





নবম পরিচ্ছেদ



এখন প্রতিদিন রাজু আর পিয়া একই ট্রেনে কলেজ যায়। একইসঙ্গে ফিরে আসে । যাতায়াতের পথে ওরা গল্প করে.... প্রাণ উজাড় করে কথা বলে । একদিন পিয়া রাজুকে বলল, - চলো আমরা কালকে দুজনে গিয়ে হাজারদুয়ারি প্যালেস দেখে আসি । রাজু তৎক্ষণাতে রাজি হয়ে গেল।

  রাজি তো হল ; কিন্তু টাকা? দুজনেই মিলে একসঙ্গে ঘুরে ঘুরে শুধু হাজারদুয়ারি দেখার কথা ভাবলেই তো আর হবে না, এর সঙ্গে সঙ্গে যে পকেটটাও ফাঁকা হয়ে যাবে তার কথাও তো ভাবতে হবে? সুতরাং বাড়ি ফিরে রাজু ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কোথায় পাবে সে টাকা? তার কাছে তো মোটে পঞ্চাশ টাকা পুঁজি। পিয়াকে নিয়ে ঘুরতে বেরোলে খুব কম করে হলেও দু'শো/তিনশো টাকা তো খরচ হবেই। এমনকি তাতেও হবে কিনা সন্দেহ। রাজুর চিন্তা বাড়তে লাগলো; অনেক ভেবে চিন্তে সে এক উপায় বের করল।

  সকাল বেলা মায়ের কাছে গিয়ে বলল, - মা পাঁচশো টাকা দাও তো, কলেজে লাগবে।
   মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, - সে কিরে, তুই যে বই কেনার জন্য অত টাকা নিলি; তারপর বললি এক বছর কলেজে আর কোন টাকা লাগবে না! এখন আবার কিসের টাকা?
  রাজু মাথা চুলকে জবাব দিল, -- টাকা লাগবে না সেটা তো আমিও ভেবেছিলাম ; কিন্তু এখন আবার ফর্ম ফিলাপ করার জন্য পাঁচশো টাকা চাইছে।
   মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে রান্না করতে করতে বললেন, -- ঠিক আছে, এখন তো আমার কাছে টাকা নেই; দু চারদিন পরে ফর্ম ফিলাপ করিস।
  -- দু চার দিন পর?
   রাজু একেবারে ভেঙে পড়ল, - দু চার দিন পর আমি টাকা কি করব? আজকেই লাস্ট ডেট!
  -- আজকেই লাস্ট ডেট তো তুই দুদিন আগে আমাকে বললি না?......... থাম তোর বাবার কাছে দেখছি।

  রাজুর বাবা ইজাজ সেখ ঘরের মধ্যে দোকানের খাতা নিয়ে বসে হিসাব করছিলেন। মা ঘরে ঢুকে কোনরকম ভূমিকা না করেই বললেন, - তোমার কাছে পাঁচশো টাকা থাকে তো দাও তো?
   টাকার কথা শুনেই ইজাজ সাহেবের মেজাজ সপ্তমে চড়ে  গেল। তিনি দাঁত খিঁচিয়ে জবাব দিলেন, - টাকা - টাকা - টাকা ....... আমি কি টাকার গাছ যে চাইলেই টাকা পাওয়া যাবে?..... টাকা পাবো কোথায় আমি?...... এক মুহূর্ত শান্তি নেই....... উঠতে টাকা বসতে টাকা...... টাকা- টাকা-টাকা...... টাকার গুষ্টিকে বেচি।
  -- তোমার টাকার অভাব তো লটারি কাটতে যাও কেন? এই যেদিন থেকে তুমি লটারি কাটতে শুরু করেছো, সেইদিন থেকেই বাড়িতে শুরু হয়েছে এত অভাব আর অশান্তি।
  -- আমি লটারি কাটবো .... একশো বার কাটবো..... কারো বাপের টাকায় আমি লটারি কাটি না । আমি আমার নিজের টাকায় লটারি কাটি।
  -- তুমি লটারি কাটো.... যত পারো কাটো... লটারি কাটো আর ভিখারি হও.... শেষে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে রাস্তা রাস্তা ভিক্ষা করগে..... তা আমার দেখার দরকার নেই। তোমার ছেলে মেয়ে নিয়ে তুমি থাকো;  ওদের দুটো খাওয়া পরার কথা ভাবো আর না ভাবো আমি আর এসব দেখতে যাব না। আমার দুচোখ যেদিকে যাবে আমি সেদিকে চলে যাব। না হয় তোমার অত্যাচারে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরবো। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
  ইজাজ সাহেব রাগে গরগর করতে করতে বললেন, - যা, যে যেখানে পারবি সেখানে চলে যা। আমার কারো দরকার নেই। বরং আমি একা একা থাকবো যে কেউ এসে আর আমাকে টাকার জন্য ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে না।

  তীব্র অপমান আর যন্ত্রণায় মায়ের চোখে জল চলে এলো। তিনি আর কোন উত্তর দিতে পারলেন না ; নিজের ঘরে চলে এলেন‌। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখমুখ মুছে ফেললেন । তার চোখের সামনে ভেসে উঠল অতীতের কয়েকটি স্মৃতি - আজকের এই মানুষটি-ই যার কাছে শুধু কটু কথাই শোনা যায়, সে-ই একদিন তাকে কতই না ভালোবাসতো! একদিনের জন্যও তাকে আঘাত দিয়ে কথা বলেনি। সংসারে তখন টাকার অভাব ছিল না;  ভালোবাসারও অভাব ছিল না। আজকে আর টাকা নেই;  ভালোবাসাও বিষাক্ত হয়ে গেছে।

  রাজু ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো, মা নিজের মনে বিড়বিড় করে কি সব বলছে। সে আর লজ্জায় মায়ের সামনে যেতে পারল না। নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগলো। তার জন্যই আজ মা আঘাত পেল। সে যদি মিথ্যে কথা না বলত.....  যদি টাকা না চাইতো..... ছি ছি ছি ছি! গরীবের ছেলের এত শখ! বাড়িতে দু'মুঠো খেতে গিয়ে যাদের টানাটানি পড়ে যায় তাদের এত বড় স্বপ্ন? পাঁচশো টাকা খরচ করে যাবে ঘুরতে? এসব সাজে বড়লোকদের। যাদের টাকা আছে, তাদের ভালবাসার অধিকারও আছে। গরিবদের ভালোবাসা নিয়ে স্বপ্ন দেখা উচিত নয়। 
 অথচ তারাও তো একদিন এতটা গরিব ছিল না। দিব্যি তাদের হাতে টাকা পয়সা ছিল। কিন্তু তার বাবার লটারি কাটার নেশাটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো...... ওর জন্যই আজ সংসারে এত অধঃপতন। রাজুর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো তার বাবার উপর। কিভাবে লটারি কেটে কেটে ও বাড়িতে অশান্তি সৃষ্টি করছে তা ভেবে ওর মাথায় আগুন ধরে গেল। তার বাবার প্রতি তীব্র আক্রোশে ফোঁস ফোঁস করতে করতে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। সে ঠিক করে ফেলল আর হাজারদুয়ারি যাবে না। পিয়াকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কলেজ থেকেই ঘুরে আসবে।


  আজকে পিয়া অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই সাজগোজ করে এসেছে। মুখে হাসি হাসি ভাব। ঘাড়ে ঝুলছে কলেজের ব্যাগ, হাতে বাঁধা লেডিস ঘড়ি। স্টেশনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত পায়চারি করছে আর মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ট্রেনের এখনো কিছুটা দেরি আছে। আজকে সে একটু আগেভাগেই স্টেশন পৌঁছে গেছে। এই ট্রেনেই ওরা কলেজ যায়। আজকেও কলেজের নাম করেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে - কিন্তু আজকের উদ্দেশ্য আলাদা।

  কিছুক্ষণ পরে পিয়া রাজুকে দেখতে পেল। কিন্তু সে যেভাবে তাকে দেখার আশা করেছিল ঠিক সেভাবে তাকে দেখতে পেল না। অন্য দিনের মতোই সাদামাটা। মুখে হাসি খুশির লেস মাত্রও নেই।
   কাছে এসে অনেকটা জোর করেই মুখে শুকনো হাসি টেনে এনে রাজু জিজ্ঞেস করল, - তুমি চলে এসেছো?
   পিয়া একটু অবাক হলো। বলল, - হ্যাঁ অনেকক্ষণ হয়ে গেল এসেছি।

  এবার রাজু ইতস্তত করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, - আজকে তো আর হাজারদুয়ারি যাওয়া হবে না। চলো কলেজ থেকেই ঘুরে আসি।
   পিয়া একেবারে আকাশ থেকে পড়ল, - কেন যাওয়া হবে না?
  -- তোমাকে কালকে হয়তো বলা হয়নি, আজকের ক্লাসটা খুব ইম্পরট্যান্ট - এটা মিস করলে আমার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। আজকে চলো কলেজ; অন্য আর একদিন না হয় হাজারদুয়ারি দেখে আসব।
  -- বাহ্ খুব ভালো তো!  তোমার ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে, আর আমার বুঝে কোন ক্লাস নেই? তার থেকে সরাসরি বলে দাও না, আমার সঙ্গে হাজার দুয়ারী ঘোরার কোনো ইচ্ছা তোমার নেই। সব লেঠা চুকে যাক।
  -- ছি ছি ছি ছি! তুমি ভুল বুঝছো। ব্যাপারটাকে তুমি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছো। সামান্য একটা ব্যাপার...... আজকে না হবে দুদিন পরে হবে..... এতে এত রাগের কি আছে?
  -- সামান্য ব্যাপার?.... হ্যাঁ হবেই তো! আমার সব ব্যাপারই তো তোমার কাছে সামান্য।...... থাক্ আর হাজার দুয়ারে গিয়ে লাভ নেই। তুমি তোমার ইম্পরট্যান্ট ক্লাস করোগে - আমি বাড়ি যাই।

  পিয়া রাগ দেখিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো। রাজু কোন উপায় না দেখে খপ্ করে পিয়ার হাতখানা ধরে নিয়ে বলল, -- রাগ করো না সোনা আমার। আমি আগে ভাবতেই পারিনি যে এমন অবস্থা হবে। না হলে অবশ্যই প্রস্তুত হয়ে আসতাম। প্লিজ পিয়া, আমার কথা একবার শোনো। আমি এখনই না হয় তোমাকে নিয়ে হাজারদুয়ারি ঘুরে আসতাম - কিন্তু বাড়ি থেকে একদম টাকা পয়সা নিয়ে আসিনি।

  পিয়া তার হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। রাজুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, -- তোমাকে টাকা পয়সার কথা কে বলেছে? আমি কি বলেছি যে আমাকে ঘোরানোর জন্য তোমাকে টাকা খরচ করতে হবে। এই সামান্য লালবাগ ঘুরতে এমন কি খরচ হবে যে তুমি টাকা পয়সার কথা তুলছো?
  -- কিন্তু পিয়া, এমনি এমনি খালি হাতে তো আর কোথাও বেরোনো যায় না?
  -- খালি হাত কোথায়? আমার কাছে এক হাজার টাকা আছে। দুজনের পক্ষে এটাই যথেষ্ট।

  রাজু আর কোন উত্তর দিতে পারল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ভাবতে শুরু করলো, কি বিচিত্র এই পৃথিবী! সামান্য পাঁচশো টাকা চাইতে গেলে একজনের বাড়িতে মারামারি শুরু হয়ে যায়। আর অন্যজন অনায়াসেই বাড়ি থেকে হাজার টাকা নিয়ে আসে। অথচ তার তো টাকা খরচ করার কোন দায় নেই! সে তো মেয়ে মানুষ। তার খরচের সমস্ত দায়িত্বই নেওয়া উচিত পুরুষটিকে। কিন্তু পুরুষটিই আজ অসহায়।

  ট্রেন ঢুকে গেল। দুজনে তাতে উঠে পড়ল। তারপর পৌঁছে গেল লালবাগ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা ভাড়া করে সোজা হাজারদুয়ারী প্যালেস। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল পিয়া। রাজুর নিজেকে কেমন যেন ছোট মনে হতে লাগলো। তার কাছে কোন পয়সা নেই। সে পিয়ার টাকায় ভ্রমণ করতে এসেছে। তার মনটা বিষন্ন হয়ে গেল।
  পিয়া কিন্তু ভীষণ উৎফুল্ল। ভাড়া মিটিয়ে প্যালেসের দিকে তাকিয়ে যেন আনন্দে নিচে উঠলো, -- আহ্, আজ কত মানুষ দেখেছ রাজু? বাইরে থেকে আজ কত মানুষ এসেছে হাজারদুয়ারি দেখতে!
 রাজু মাথা নেড়ে সায় দিল। কিন্তু তার মত আনন্দ পেল না। পিয়া প্যালেসে ঢোকার জন্য টিকিট কেটে নিয়ে এলো। তারপর রাজুর হাতখানা নিজের হাতের আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে হাঁটতে শুরু করল। আজ সে ভীষণ খুশি। স্বাধীনতা কাকে বলে আজ যেন সে প্রতি পদে পদে টের পাচ্ছে।

  -- জানো রাজু, অনেক দিন আগে আমি হাজারদুয়ারি দেখেছি। তখন আমি অনেকটা ছোট ছিলাম ; অত কিছু বুঝতাম না। তবুও ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে ছিল ছোট মামা। মামাই আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছিল। প্যালেসের ভিতরে রাখা নবাবী আমলের বন্দুক, পিস্তল, ঢাল, তলোয়ার, তারপর সিংহাসন, তাদের ব্যবহার করা খাট, পালঙ্ক - এসব কিছুই আমি খুব অবাক হয়ে দেখেছিলাম। নবাবদের সব আশ্চর্য আশ্চর্য কাহিনী মামা আমাকে বলেছিল। সেগুলো শুনে আমার মনটা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না।........  আচ্ছা, এর আগে তুমি কতবার হাজারদুয়ারি এসেছো?
  -- দুবার এসেছি। একবার খুব ছোটবেলায় ।আর একবার এই দু' এক বছর আগে এসেছিলাম।

  দুজনে পাশাপাশি খুব ঘরিষ্ঠভাবে হেঁটে হেঁটে দেখল হাজারদুয়ারি। প্যালেসের সভাকক্ষে যেখানে নবাব তার পরিষদবর্গের সঙ্গে সিংহাসনে বসে রাজকার্য চালাতেন, সেখানে এসে ওরা কিছুক্ষণ দাঁড়ালো।
   অপলক দৃষ্টিতে সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে রাজু ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, - দেখো পিয়া, পৃথিবীতে রাজত্বের মূল্য কোথায়? ধন-সম্পদের মূল্য কোথায়? এই সিংহাসনেই বসে বসে একদিন নবাব রাজকার্য চালাতেন। তার সামনে শত শত মানুষ এসে সেলাম ঠুকে যেত।..... এই তো এখানেই তো তারা এসে দাঁড়াতো..... এখনো হয়তো তাদের পায়ের ছাপ এই মেঝেতে লেগে আছে।...... এইতো এই সিংহাসন, এখানেই বসে নবাব তাদের কথা শুনতেন । সিংহাসনের এই হাতলটিতে নবাবের হাতের স্পর্শ এখনো লেগে আছে। সবই তো আছে.. প্রাসাদ আছে...... সিংহাসন আছে.... সভাঘর আছে.... এমনকি মানুষও আছে। কিন্তু নবাব?.... তার পরিষদবর্গ? এরা সব গেল কোথায়? এরা কি আর কখনো ফিরে আসবে এই পৃথিবীতে? সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কি এদের পাওয়া যাবে?...... আজকে আমরা এই প্রাসাদে দাঁড়িয়ে আছি পিয়া.... এখনো প্রাসাদটি কত সুন্দর হয়ে আছে.... কিন্তু একদিন এই প্রাসাদটিও থাকবে না। এটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সেদিন হয়তো নতুন কোন মানুষ এই ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা-ই চিন্তা করবে। তারপর সেও ধ্বংস হয়ে যাবে..... কিছুই থাকবে না পিয়া। পৃথিবীর সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে..... আমরাও শেষ হয়ে যাব।

  পিয়া উদাস হয়ে রাজুর কথাগুলো শুনছিল। সভা ঘর থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। এখানে এসে রাজু আবার বলতে শুরু করলো, - একদিন এই বারান্দায় নবাব পরিবারের ছেলে মেয়েরা খেলা করত। ওরা একে অপরকে চিৎকার করে হয়তো ডাকাডাকি করত। তাদের সেই ডাক আজও এই প্রাসাদের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে...... ভালো করে কান পেতে শোনো পিয়া....... এখনো সেই ডাক শোনা যাচ্ছে....  তাদের সেই চিৎকার চেঁচামেচি আমি এখনো শুনতে পাচ্ছি।...... ইস্ কতই না আনন্দ তারা একদিন পেয়েছিল..... তুমি আর আমি আজ যেমন হাত ধরা ধরি করে দাঁড়িয়ে আছি, তাদের মধ্যে কোন প্রেমিক প্রেমিকা হয়তো একদিন ঠিক এই ভাবেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে কথা বলেছিল। এই মেঝেতেই দাঁড়িয়ে হয়তো তারা হাসির বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। তারপর......
   রাজু হঠাৎ থেমে গেল। পিয়ার দিকে কিছুক্ষন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আবার বলতে শুরু করল, - তারা ভালোবেসে হয়তো প্রচুর আনন্দ পেয়েছিল পিয়া........ প্রাণ ভরে ভালবেসে ছিল..... ইচ্ছে মতো নিজের স্বপ্নকে সাজিয়ে তুলেছিল, কারণ তাদের হাতে ছিল অঢেল সম্পদ। আজকে আমিও তোমাকে ভালোবাসি পিয়া; কিন্তু নিজের স্বপ্নকে সাজিয়ে তুলতে পারি না। কারণ আমি সম্পদ হীন গরিবের ছেলে ; আর তুমি সম্পদশালী বড় লোকের মেয়ে। দুজনের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

  পিয়া এতক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাজুর কথাগুলি শুনছিল । কিন্তু রাজুর শেষ কথায় সে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো, -- বড়লোকের মেয়ে, বড়লোকের মেয়ে বলে আর কত অপমান করবে তুমি? এই একটি কথাই তোমার মুখ থেকে বেশ কয়েকবার শুনেছি। আর এই কথাটি শুনতে আমার খুব খারাপ লাগে। কেন নিজেকে এত ছোট মনে করো? কিসের গরিব তোমরা? আর আমরাই বা বড়লোক কিসের? এক্ষুনি তো তুমি বললে, এই পৃথিবী থেকে সবাই চলে যাবে - গরিব হোক আর বড়লোক হোক কেউ থাকবে না। তাহলে শুধু শুধু গরীব-বড়লোকের প্রশ্ন তুলছো কেন? আমি তোমাকে ভালবাসি...... তোমাকে ভালবেসে আমি আনন্দ পেয়েছি..... তোমার মাঝে আমি সবকিছুই খুজে পেয়েছি। তোমাকে আমার ভালো লাগে রাজু...... বড্ড ভালো লাগে..... কিন্তু তোমার ওই কথাটাই আমার কাছে বিষাক্ত। প্লিজ রাজু, আমাদের সম্পর্কের মাঝে আর কখনো গরিব বড়লোকের প্রশ্নটি তুলে এনো না।

  রাজু নিচু দিকে মুখ করে একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে পিয়ার হাত ধরে বলল, -- চলো ঐ দিকটা এখনো দেখা হয়নি - ঘুরে আসি।

 হাজারদুয়ারি প্যালেস থেকে বেরিয়ে পিয়া বলল, -- এবার চলো মতিঝিল।
  -- মতিঝিল যাবে? কিন্তু দেরি হয়ে গেলে বাড়িতে তোমাকে কিছু বলবেনা তো?
  -- আমার বাড়িতে আমাকে কি বলবে, কি না বলবে, সে নিয়ে তোমাকে বেশি ভাবতে হবে না । তোমার নিজের কোন আপত্তি থাকলে বলতে পারো।

  রাজু ভাবছিল তার পকেটের দুর্দশার কথা। এদিকে পিয়ার হুকুম ; অমান্য করার উপায় নেই । তাই মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, -- না না, আপত্তি থাকবে কেন? চলো একবার ঘুরেই আসা যাক।

  একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে পিয়া রাজুর হাত ধরে দোকানে ঢুকতে গেল । রাজু হঠাৎ বলে উঠলো, -- একি? কোথায় যাচ্ছ?
  -- মিষ্টি টিস্টি কিছু খাব না ? সারাদিন শুধু শুধু ঘুরে বেড়াবো?
  --  কিন্তু দেখো পিয়া, আমি মিষ্টি ফিষ্টি বেশি খেতে পারি না।
  -- মিষ্টি না খাবে, অন্য কিছু খাবে।
  -- অন্য কিছু?

  রাজু মনে মনে প্রমাদ গুনলো - এখানে খাওয়া মানেই পিয়ার খরচ। পিয়ার টাকা খরচ করতে তার বিবেকে বাধছিল। তাই যথাসম্ভব কম দামের কিছু খাবার খেয়ে সে উঠে যেতে চাইছিল। কিন্তু পিয়া তাকে ছাড়লো না। প্রায় জোর করেই খাওয়ালো দামী দামী খাবার।

  দোকানের বিল মিটিয়ে পিয়া রাজুকে নিয়ে উঠে পড়ল একটা রিক্সায়। টিকিট কেটে ঢুকে পড়লো মতিঝিল পার্কে।

এই পার্কের ঠিক মাঝখানে একটি পুকুর রয়েছে। তার পাড় ঘেঁষে স্থানে স্থানে ফুলের বাগান। পার্কের বেশিরভাগ অংশেই আমের বাগান। দুজনে মিলে পার্কের এদিক-সেদিক ভালোভাবে ঘুরে ফিরে দেখল। তারপর পার্কের শেষ প্রান্তে এক কোনায় ফাঁকা মত একটা জায়গায় ঘাসের উপর গিয়ে বসলো।

  রাজুর হাতখানা কোলের উপর টেনে নিয়ে পিয়া বিশেষ এক রহস্যময় ভঙ্গিতে মুচকি মুচকি হেসে তার আঙ্গুল গুলি টিপতে শুরু করল। পিয়ার হাসি বড়ই মায়াবি। বেচারা রাজুর পক্ষে এ হাসির অর্থ বোঝা সম্ভব হলো না। সে গোবেচারা ভালো মানুষের মতো প্রশ্ন করল, -- হাসছো কেন?
  পিয়া তার হাসির মধ্যে আরও বেশি রহস্য মাখিয়ে উত্তর দিল, -- রাজাকে চেনো ? ওর কথা ভেবেই হাসি পাচ্ছে।
  -- রাজা? কোথায় বাড়ি ওর?
  -- রাজা কে চেনো না? আরে ছি ছি ছি! রাজাই তো আমার জীবনের সবথেকে বড় বন্ধু.... আমার জীবনের অংশ.... আমার জীবন সঙ্গী.... ওকে ছাড়া আমি বাঁচতেই পারব না।

  রাজুর শিরায় শিরায় হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ওর সমস্ত চিন্তাশক্তি মুহূর্তের মধ্যে লুপ্ত হয়ে গেল। হাঁ করে পিয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো - কোনো উত্তর দিতে পারল না।

  রাজুর মুখের করুন দশা দেখে পিয়ার ভীষণ হাসি পেল। সে আবার বলতে শুরু করল, -- তোমাকে হয়তো বলা হয়নি, রাজার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। ওকে ছাড়া আমি কাউকেও স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারব না। রাজা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে, আমিও ওকে ভীষণ ভালোবাসি। ও সব সময় আমার মনের মধ্যেই থাকে.... এই যে এখন আমি তোমার সঙ্গে গল্প করছি, কিন্তু এখনো রাজা আমার মনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। ও আমার স্বপ্নে এসে গান গেয়ে যায়..... ভোরের আলোয় শিষ দিয়ে যায়.... দুপুরবেলায় গল্প শোনায়। কিন্তু আমার বড় কষ্ট হয় রাজু। ওকে আমি এত কাছে পেতে চাই, একেবারে বুকের মাঝে বেঁধে রাখতে চাই ; কিন্তু পারি না। ও থাকে অনেক দূরে.... বিদেশে.... আর আমি দেশের মাটিতে ওর জন্য হা পিত্যেশ করে মরি। জানো রাজু, আজ কয়দিন থেকে খুব কষ্ট করে ওর জন্য একটা জিনিস তৈরি করে রেখেছি। ওকে উপহার হিসেবে দেবো বলে। দেখবে?

  রাজুর মুখ শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে । গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোচ্ছে না। তবুও নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে টেনে টেনে সে বলার চেষ্টা করল, -- না না, থা.. থাক থাক.... এখন না, প... পরে....

  পিয়া কিন্তু ছাড়ার পাত্রী নয়। রাজুর কষ্টের কথা সে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। কিংবা রাজুর দুঃখের কোন মূল্যই যেন তার কাছে নেই - এমন ভঙ্গি দেখিয়ে মুচকি মুচকি হেসে বলে উঠলো, -- না না, সে কি হয়? পরে কখন সময় হবে, কি না হবে, তার ঠিক নেই । বরং এটা এখনই দেখে নাও। 

  এবার সে তার কলেজের ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা ব্যাগ বের করল। সেই ছোট্ট ব্যাগের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো একটা ভাঁজ করা সাদা রুমাল । রুমালের ভাঁজ খুলে পিয়া রাজুর সামনে মেলে ধরে বলল, -- কেমন লাগছে দেখতে? এর পুরো নকশা আমি নিজের হাতে তৈরি করেছি। বাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে তৈরি করতাম। মা জানতে পারেনি।

  রাজু দেখল এবং বুক ভরা ব্যথা নিয়েই দেখল। দেখল, রুমালের চার কোনায় চারটি গোলাপ ফুল বহু যত্নে লাল সুতো দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। মধ্যেখানে বড় আকারের একটা 'লাভ' চিহ্ন। তার মাঝে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে - "রাজা"।

  রাজুর কান্না পেতে লাগলো। নিজেকে খুব কষ্টে সামলে নিয়ে জোর করে ঠোঁটের চারিপাশে শুকনো কাঠের মত একটা বিকৃত হাসির রেখা টেনে এনে প্রশংসা করলো সুন্দর হয়েছে।

  পিয়া খুশি হয়ে বলল, -- রাজাকে এই উপহারটা আমি দেব। যখন ও আমার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে শুয়ে থাকবে; আমি ওর কপালে একটা চুমু খাব, তারপর ওর হাতে আর একটা চুমু খেয়ে আমি ওর হাতে রুমালটা ধরিয়ে দেব। এই  রুমালের সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনটাও ওর হাতে সঁপে দেব।

  রাজু সেখান থেকে মাথা নিচু করে উঠে যাচ্ছে দেখে, পিয়া ওর হাতখানা খপ করে ধরে নিয়ে আবার টেনে বসালো। দেখল, ওর দু চোখ ছল ছল করে উঠেছে। রাজু কোন উত্তর দিল না - অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।

   রাজুর করুন অবস্থা দেখে পিয়া ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর ধীরে ধীরে তাকে কাছে টেনে নিয়ে, তার কপালে একটা চুমু খেলো। তাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বলল, -- খুব কষ্ট পেলে তাই না? এসো তোমার মাথা টিপে দিই। আমার কোলে মাথা রেখে একটু শুয়ে পড়ো। 

  রাজু কিন্তু নড়লো না । পিয়া এবার জোর করে থাকে শুইয়ে দিয়ে তার মাথাটি কোলের উপর তুলে নিল রাজু। রাজু চোখ বন্ধ করে ফেলল ; আর উঠে যাওয়ার চেষ্টা করল না। পিয়া ধীরে ধীরে তার ঠোঁটটি রাজুর কপালের কাছে নিয়ে এলো ; তারপর একটা চুমু খেয়ে ফিস ফিস করে বলতে শুরু করলো, -- তুমি এমন ছেলে আমি ভাবতেও পারিনি। আমি রাজার কথা বললাম আর তোমার মন খারাপ হয়ে গেল? একবারও ভেবে দেখলে না রাজাটা আসলে কে? তুমি তো জানো, আমি তোমাকেই ভালোবাসি। তাহলে আমার জীবনে তুমি ছাড়া আর কে থাকতে পারে?
  আসলে তুমি জানো যে আমি তোমাকে ভালোবাসি - কিন্তু কতটা ভালবাসি তুমি তা জানো না। জানলে আমার কথাগুলি তুমি ধরে ফেলতে। আমার জীবনের রাজা মহারাজা তো তুমিই । আমি তোমাকে রাজা হিসেবে চিনি..... তুমিই আমার মহারাজ...... তুমিই তো আমার জীবনের সর্বক্ষণের সঙ্গী। তোমাকে ছাড়া আমার জীবনের কথা আমি ভাবতেই পারি না। আমি মনে মনে তোমার নাম রেখেছি 'রাজা'...... আমার 'রাজা'...... শুধুমাত্র আমার.....

  রাজুর হাতটা টেনে নিয়ে তাতে রুমালটা গুঁজে দিয়ে পিয়া আবার বলতে শুরু করল, -- আজকে এই রুমালটা তোমাকে উপহার দিলাম। এটা রেখে দিও.... এটা শুধু রুমাল নয় রাজা..... এটা আমার জীবন..... যত্ন করে রেখো..... হারিয়ে ফেলো না..... যেদিন আমি তোমার গিন্নি হিসেবে তোমার কাছে যাবো, সেদিন কিন্তু প্রথমেই আমি এই রুমালটার কথাই তোমাকে জিজ্ঞেস করবো - দেখব কেমন যত্নে এটা রেখেছো।

  রাজু এতক্ষণ চোখ বুজে পিয়ার কথাগুলি শুনছিল। এবার রুমালটা হাতে নিয়ে একবার দেখল - তারপর পিয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার চোখ বুজে ফেলল।

  পিয়া তার ঠোঁটখানা রাজুর একেবারে কানের পাশে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, -- কি ব্যাপার মহারাজ! এখনো কি রেগে আছেন? রাজাদের কিন্তু এত রাগ ভালো নয় - এতে প্রজার ক্ষতি।

মহারাজ কিন্তু চোখ খুলল না। মহারানীর হাতখানা বুকের উপর তুলে নিয়ে নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরে ধীরে ধীরে বলল, -- তুমি আজ যাকে মহারাজ বললে, যাকে রাজা বলে স্বীকার করে নিলে, সে কি তার যোগ্য? অযোগ্য ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসিয়ে শেষে কষ্ট পাবে না তো? তুমি বলছো রাজাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না - কিন্তু তোমার রাজাকে তোমার বাবা-মা মেনে নেবে তো? যদি তোমার রাজাকে তারা ছুঁড়ে ফেলে দেয়?

  পিয়া এবার রাজুর মাথাটা একেবারে বুকের মাঝে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, -- তুমি আমার বাবা মাকে চেনো না রাজা। আমি যা বলব আমার বাবা-মা তাই করতে বাধ্য। আমার মা একেবারে আমার বান্ধবীর মত। মায়ের সঙ্গে আমি সব কিছুই খুলে বলতে পারি । মাকে আমি যা-ই বলি সবই মেনে নেয়। আমি যদি মাকে বলি আমি তোমাকে ছাড়া আর অন্য কাউকে বিয়ে করব না তাহলে মা অবশ্যই তা মেনে নেবে। আমি তো বাড়িতে নিজের ইচ্ছাতেই চলি। কারো কথা মেনে চলতে আমার ভালো লাগেনা।
  -- কিন্তু পিয়া, আমার বড্ড ভয় হয় - পৃথিবীটা বড়ই নিষ্ঠুর - এর হিসেব বোঝা বড়ই কঠিন। আমার ভয় হয় তোমাকে হয়তো কখন হারিয়ে ফেলবো। জানিনা তোমাকে আমার চির জীবনের সঙ্গী হিসেবে পাব কিনা। যদি পাই, তবে আমার মত সৌভাগ্যবান পৃথিবীতে আর কে হতে পারে? এই যে তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি, মনে হচ্ছে যেন জন্ম জন্মান্তরে এভাবেই শুয়ে থাকি। পৃথিবীর সমস্ত শান্তি তো এখানেই লুকিয়ে আছে পিয়া। এই বিষাক্ত পৃথিবীতে একমাত্র সুখের আশ্রয় তো এটাই। এর কাছে স্বর্গের সুখও তুচ্ছ হয়ে যায়। 
আমার কেবলই মনে হয় তোমার সাথে মিলেমিশে আমি একাকার হয়ে যায়। তোমার বুকের মাঝে আমি চিরজীবন লুকিয়ে থাকবো - কেউ কখনো খুঁজে পাবে না। কেউ তোমার থেকে আমাকে আলাদাও করতে পারবে না। তুমি আর আমি..... শুধুই তুমি আর আমি.... বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যেদিকেই তাকাই সেদিকেই দেখতে পাই শুধুই তুমি আর আমি..... তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর কিছুই নেই পিয়া...... সবকিছুই অন্ধকার।
  এই অন্ধকার জীবনে একমাত্র আলো শুধুই তুমি। ......আমার জীবন এতো অন্ধকারময় কেন পিয়া? শুধু আমার জীবন কেন, সমস্ত পৃথিবীটাই তো আমার অন্ধকারময়।.... আমি শুধু স্বপ্ন দেখি অন্য এক পৃথিবীর...... আলোকিত পৃথিবী..... যেখানে তুমি আর আমি হাত ধরা ধরি করে ঘুরে বেড়াচ্ছি । যেখানে খুশি সেখানেই যাচ্ছি। কোন বাধা নিষেধ কিচ্ছু নেই । সেই পৃথিবীতে বাড়ি নেই, ঘর নেই, জমি নেই, জায়গা নেই, টাকা নেই, পয়সা নেই, গরিব বড়লোক কিছুই নেই...... সেখানে শুধুই আছে ভালোবাসা...... অফুরন্ত ভালোবাসা...... ভালোবাসাতেই সমস্ত চাহিদা মিটিয়ে ফেলে। তুমি আর আমি সেই পৃথিবীতেই চলে যাবো পিয়া। দুজনে দুজনকে ভালোবাসবো.... প্রান ভরে ভালোবাসবো। সেই ভালোবাসার মাঝে কোন আশঙ্কা থাকবে না;  ভয় থাকবে না। শুধু থাকবে আনন্দ..... শুধুই আনন্দ।.......
  ঐ দিকে তাকিয়ে দেখো পিয়া আম গাছের ডালে শালিক পাখি দুটি বসে আছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে দুজনকে! ওরা দুজন দুজনকে কিচিরমিচির করে কি যেন বলাবলি করছে..... দেখেছো পিয়া, কি দারুন আনন্দে ওরা দুজনেই মাথা নেড়ে নেড়ে সায় দিচ্ছে। সামনের দিকে মাথা ঝোঁকাচ্ছে..... যেন ওরা পরস্পর পরস্পরের প্রতিটি কথাই বিনা প্রতিবাদে মেনে নিচ্ছে.... ওদের দেখে আমার ভীষণ হিংসে হয় পিয়া - ওরাই আমার সেই স্বপ্নের জগতে বাস করে। ওদের বড় বড় অট্টালিকা নেই, জমি জায়গা ধন দৌলত কিচ্ছু নেই। অথচ দেখেছো, সমস্ত পৃথিবীটাই যেন ওদের পায়ের নিচে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে..... পৃথিবীর সমস্ত জমি জায়গাই ওদের.... ওরা যেখানে খুশি যেতে পারে.... কারো কোন বাধা দেবার ক্ষমতা নেই। আমি আর তুমি যদি ওই রকমই পাখি হয়ে জন্ম নিতাম.... কতই না ভালো হতো.... বাবা মায়ের কাছে  টাকা চাইতে হতো না। সংসারের কথা ভাবতে হতো না। দুজনে মিলে গাছের ডালে ডালে উড়ে বেড়াতাম.... সারাদিন সারারাত  দুজনে গলাগলি করে কিচিরমিচি করতাম...... এক মুহূর্তের জন্যও আলাদা হতাম না...... প্রান ভরে দিনরাত তোমায় দেখতাম...... তোমায় দেখে দেখেই আমার সমস্ত জীবনটা কাটিয়ে দিতাম।.....

  পিয়া এতক্ষণ রাজুর হাতের আঙ্গুলগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। রাজু এবার পিয়ার হাতখানা নিজের দুই হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরে একেবারে ঠোঁটের কাছে নিয়ে এসে প্রশ্ন করলো, -- আচ্ছা পিয়া, তুমি এত সুন্দর। আমার তো মনে হয় সমস্ত পৃথিবীটা খুঁজলেও তোমার মত সুন্দর কাউকে পাওয়া যাবে না। এমন সুন্দর হয়েও কিভাবে তুমি আমার মত একটা ছেলেকে পছন্দ করলে?
  -- তোমার পাগলামো দেখে। তোমার পাগলামি পাগলামি কথা শুনে। পাগল না হলে কি কেউ এ ধরনের কথা বলে?
  -- হ্যাঁ পিয়া আমি পাগল.... সত্যই একদিন তোমার জন্য পাগল হয়ে যাব..... তখন দেখবে...
  -- থাক থাক, আর পাগল হয়ে কাজ নেই। যা পাগল হয়েছো এ-ই যথেষ্ট। তোমার এই পাগলামি দেখেই তো আমিও পাগল হয়ে গেছি। এর বেশি পাগল হলে একদিন দুজনকেই পাগলা গারদে ভর্তি হতে হবে। এবার চলো উঠি। ট্রেনের সময় হয়ে গেল। তোমার মত পাগলের খপ্পরে পড়লে তখন আর কোনদিন বাড়ি ফিরতেই ইচ্ছে করবে না।

  রাজু উঠে দাঁড়িয়ে গা মোড়া দিয়ে বলল, -- চল পিয়া, দুই পাগলা পাগলীতে বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যায়।
  -- পালাবো পালাবো। সময় হলেই পালাবো। এখন আগে তাড়াতাড়ি স্টেশন চলো। তা না হলে ট্রেন ফেল হবে।





দশম পরিচ্ছেদ





শীতের দিন। বিকেল বেলার অস্তগামী সূর্যের তেজ বড়ই মিষ্টি। পিয়ার মা স্নান সেরে ছাদের উপর চেয়ারে বসে চুল শুকাচ্ছিলেন। পিয়া কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে তার মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। তারপর তার মায়ের চুলগুলি নাড়াচাড়া করতে করতে মুচকি হেসে বলল, - আর জানো মা, রাজুটা এমন পাগল, সেদিন আমার ছেঁড়া বইটা পড়ার জন্য নিয়ে গেল - আজ দেখছি সেটা একেবারে বাঁধিয়ে ছাদিয়ে আমাকে ফেরত দিচ্ছে। তাতেও হয়নি - বইয়ের উপর নিজের হাতে এমন করে নকশা এঁকেছে - তুমি দেখলে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।
  -- তুই নিশ্চয়ই বাঁধাতে বলেছিলি!
  --  আমি কিছুই বলিনি। শুধু বইটা দেওয়ার সময় এমনি ঠাট্টা করে বলেছিলাম যে বইটা আমার পড়তে ভীষণ ভালো লাগে। ব্যস্ - তারপরেই ও বাঁধিয়ে নিয়ে চলে এলো। তাছাড়া তুমি জানো না, ও আমার সবকিছু নিয়েই পাগলামি করে। একদিন ওর সামনে আমি এমনি বলেছিলাম আমার আতা খেতে খুব ভালো লাগে। ব্যস্ - তার পরদিন-ই দেখছি ও আতা নিয়ে হাজির। আর একদিন আমাদের কলেজের একটি মেয়ের ব্যাগ দেখে শুধুমাত্র বলেছিলাম, ব্যাগটা খুব সুন্দর -এই রংটা আমার খুব পছন্দ। কয়েকদিন পরে দেখছি ও সমস্ত জিয়াগঞ্জ আর বহরমপুর তন্ন তন্ন করে খুঁজে, সেম ওই ধরনের একটা ব্যাগ আমাকে নিয়ে এসে দিলো। আমি ভাবতেও পারিনি যে ও এ কান্ড করে বসবে। 
  -- তুই ওর কাছ থেকে এটা সেটা নিতে যাস কেন? কি দরকার ওর কাছ থেকে এসব নেওয়ার?
  -- আমি কি নিতে চাই? ও নিজেই জোর করে দেয়। আর না নিলেও রাগ করবে।
  -- ওর সঙ্গে এত মাখামাখির কি আছে? দেওয়া-নেওয়া জিনিসটা খুব একটা ভালো নয়। এমনি দুজনে কলেজ যাতায়াত করিস, তা কর। কিন্তু ওর সঙ্গে খুব বেশি মেশামেশি করিস না।

  পিয়ার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সে রাগে গরগর করতে করতে বলল, -- কেন মেশামেশি করব না? তুমি কি ভাবছো ও নোংরা ছেলে? ও আমার কি ক্ষতি করে যে ওর সঙ্গে মিশবো না? আসলে তোমার মনের ধারণাটাই ভুল। তুমি ওর সম্পর্কে অনেক আজেবাজে কথা ভেবে বসে আছো। তুমি জানো না, ও কেমন ছেলে। জানলে এরকম কথা বলতে পারতে না।

  মেয়ের রাগ দেখে মা নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর ধীরে ধীরে বুঝিয়ে বললেন, -- দেখ পিয়া, তোর এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। নিজের জীবনের কথা এখন থেকে তোকে নিজেকেই ভাবতে হবে। আর ছেলেখেলামো করলে তো চলবে না! গত পরীক্ষায় তোর রেজাল্ট মোটেও ভালো হয়নি। এভাবে রেজাল্ট খারাপ হলে তোর পড়াশোনাটাই বাদ হয়ে যাবে। এদিক সেদিক আজেবাজে চিন্তা না করে পড়াশোনায় মন দে।..... তোকে নিয়ে তোর বাবা কত স্বপ্ন দেখে - আর এভাবে তুই যদি তোর জীবনটা শেষ করে দিস তাহলে তোর বাবা কত কষ্ট পাবে তুই ভেবে দেখেছিস?
  -- তুমি কি করে ভাবলে যে আমি আমার জীবনটা শেষ করে দিলাম? একটা পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলেই কি জীবনটা শেষ হয়ে যায়?
  -- আচ্ছা, রাজু টাও তো শুনছি আগের মত আর পড়াশোনা করে না। ওর বাড়ির এখন যা অবস্থা হয়েছে তাতে আর কোনদিনও পড়াশোনা করে কিছু করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। ওর পাল্লায় পড়ে তোর পড়াশোনারও ক্ষতি হচ্ছে। তোর জীবনের একটা আলাদা দাম আছে সেটাও তো তোকে ভাবতে হবে! এই এলাকায় তোর বাবার একটা আলাদা সম্মান আছে। টাকা-পয়সার দিক থেকেও তোর বাবা কারো থেকে পিছিয়ে নেই। তাহলে তুই যার তার পাল্লায় পড়ে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবি কেন? তুই কি চাস যে তোর বাবাকে নিয়ে লোকে হাসাহাসি করুক?
  -- আশ্চর্য ব্যাপার তো! বাবাকে নিয়ে লোকে হাসাহাসি করবে কেন? আর আমিই বা কি করলাম যে লোকে বাবাকে নিয়ে হাসবে?
  -- এই যে তুই রাজুর সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠভাবে চলাফেরা করছিস - এটাতেই তো লোকে অনেক কিছু ভেবে বসে থাকবে।
  -- লোকে কি ভাবলো, কি না ভাবলো, তাতে আমার কি? আমার যাকে ভালো লাগবে তাকে নিয়ে আমি চলব। ভালো কে আমি কোনদিনও লোকের ভয়ে ছেড়ে দেব না।
  -- দেখ পিয়া, ভালোকে কিন্তু সব সময় ভালো লাগেনা। আজকে যাকে ভালো লাগছে, কালকে তাকে ভালো না-ও লাগতে পারে। এই যে খুব বেশি দূর যেতে হবে না, জলির দিকেই একবার তাকিয়ে দেখ - বিয়ের আগে রাহুলকে ও কত ভালোবাসতো - ওর জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে চেয়েছিল। আর এখন?.....  এখন তো ছোঁড়াকে ও সহ্যই করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত হয়তো ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। আগে ওরা ভালোবাসতো... তখন সবকিছু রঙিন মনে হতো.... ভাবতো, স্বপ্ন দেখে দেখে জীবনটা কাটিয়ে দেবে। আর এখন তো সেটা নেই। বাস্তবের মাটিতে ওরা এসে দাঁড়িয়েছে। আর সেজন্যই দুজন দুজনের চোখে বিষ।
  -- ওদের কথা তুমি ছেড়ে দাও। রাহুলকে তুমি খুব ভালো ছেলে ভেবেছো নাকি? ওকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। এক নম্বরের মিচকে শয়তান। জলিকে পাগলি পেয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রেখেছিল, আর এখন ওর আসল চেহারাটা বেরিয়ে গেছে। তুমি কি ভেবেছো পৃথিবীর সবাই সেই রাহুল? দুনিয়াতে এখনও অনেক ভালো ভালো মানুষ আছে। আর রাজুর সঙ্গে অন্য কারো তুলনা করতে যেও না - কারণ তুমি ওকে চেনো না - আমি জানি ও কেমন ছেলে।
  -- ঠিক আছে, আমি মানলাম রাজু খুব ভালো ছেলে। কিন্তু ভালো ছেলে হলেই কি জীবনে সুখী হওয়া যায়? রোজগার যদি না থাকে তাহলে কেউ সুখী হতে পারবে না; সংসারে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকবে।..... তোর মামার বাড়ির পাশে যে মহিম ছেলেটা আছে, তুই তো জানিস না ছেলেটা কত ভালো - অত্যন্ত সরল আর সাদাসিধে ছেলে। কিন্তু ওর একটাই দোষ, কাজকর্ম কিচ্ছু করেনা। বসে বসে খেয়ে বাপের যা ছিল সব কিছু শেষ করে দিয়েছে। এখন ছেলেপুলে নিয়ে কি কষ্টেই না দিন কাটাচ্ছে! ছেলেমেয়ের প্রয়োজন মেটাতে পারে না... স্ত্রীর প্রয়োজন মেটাতে পারে না.... আর টাকা পয়সা নিয়ে প্রতিদিন সমানতালে চলে ঝগড়া।
  -- রাজু ঐরকম ছেলে নয়, ওর বুদ্ধি আছে। নিশ্চয় কোন না কোন উপায়ে ও ঠিক ইনকাম করে নেবে।
  -- কোন উপায়ে ইনকাম হবে? ও এখন পড়াশোনায় যেমন হয়েছে তাতে চাকরি-বাকরি পাওয়ার আশা ছেড়েই দিতে হবে। আর ব্যবসা বাণিজ্য করলেও টাকা-পয়সার দরকার। অত টাকা পাবে কোথায় ওরা? ওদের তো জমি জমাও বিশেষ কিছু নেই, যে তাতে থেকে দুটো ধান চাল হবে........

  মা সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরলেন রাজুর অসহায়ত্বের দিক - তার দুর্বলতার খুঁটিনাটি। পিয়া শুনলো। তার মায়ের কাছ থেকে রাজু সম্পর্কে এ ধরনের কথা এর আগে সে কখনো শোনেনি। বরং মাও কখনো কখনো রাজুর চরিত্রের প্রশংসাই করতেন । পিয়া তার মাকে একজন প্রকৃত বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছিল‌। সে তার মায়ের সঙ্গে সব ধরনের কথাই আলোচনা করতো - আর মাও তার কথার সঙ্গে বন্ধুর মতোই তাল মেলাতেন।
  পিয়া রাজুকে নিয়ে অনেক কথাই তার মায়ের সামনে হেসে হেসে বলত আর আনন্দ পেত। তার সঙ্গে আনন্দে তার মাও যোগ দিতেন। মা ভাবতেন পিয়া আর রাজুর মধ্যে যে সম্পর্ক সেটা নিছক একটা বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু ধীরে ধীরে তার মনের ভুল ভেঙে গেল। তিনি এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, এ সম্পর্ক অনেক গভীরে চলে গেছে। তিনি আর কোনমতে চান না রাজুর সঙ্গে পিয়ার কোন রকমের সম্পর্ক বজায় থাকুক। আজকে প্রথম পিয়ার সামনে তিনি তার মনের প্রকৃত কথাটি খুলে বললেন। এতে পিয়া আঘাত পেল - তার মনের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হল। সে এতদিন ভাবতো, মাকে সে যা-ই বলবে মা সেটাই হয়তো মেনে নেবেন; বিশেষ করে রাজুর ব্যাপারে তিনি কোন আপত্তি করবেন না ।কিন্তু আজকে মায়ের বক্তব্য শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বিশেষ করে মায়ের শেষের কথাগুলি তার সহ্য হলো না। সে সেখান থেকে রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে উঠে চলে গেল।




একাদশ পরিচ্ছেদ




রাজুর মা বেশ কিছুদিন থেকে অসুস্থতা বোধ করছিলেন। স্থানীয় হাতুড়ে ডাক্তারদের কাছে ঔষধ খেয়েও নিরাময়ের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না। বরং ধীরে ধীরে তার অবস্থার অবনতি ঘটতে শুরু করল। ইজাজ সাহেব তার স্ত্রীকে বহরমপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করালেন। সেখানে ডাক্তার বাবুরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, তার মারাত্মক অসুখ ধরা পড়েছে - ব্লাড ক্যান্সার। ইজাজ সাহেবের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। তিনি কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ডাক্তার বাবুকে তিনি বারবার বিভিন্ন ধরনের অসংলগ্ন প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। ডাক্তারবাবু জানালেন, ব্লাড ক্যান্সারের এই ধরনের রোগীরা সাধারণত বাঁচে না। সুতরাং তার পক্ষে এর নিরাময়ের দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। তিনি তাকে ইঙ্গিত দিলেন, রোগীকে কলকাতার নামি হাসপাতালে ভর্তি করালে হয়তো চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে কিছুদিন বাঁচানো যেতে পারে - কিন্তু সেটাও অত্যন্ত ব্যয় সাপেক্ষ ব্যাপার।

   ইজাজ সাহেব ডাক্তার বাবুর পরামর্শ মত রোগী নিয়ে ছুটলেন কলকাতা। সেখানে এক নামি হাসপাতালে ভর্তি করালেন। হাসপাতালে চিকিৎসা চলল কিছুদিন। কিন্তু হাসপাতালের বিপুল ব্যয়ভার বহন করা তার মতো লোহা লক্কড়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার অবস্থা দেখে ডাক্তার বাবু তাকে বললেন, -- আপনি বরং রোগী নিয়ে বাড়ি চলে যান। এই এই রোগীকে বাঁচানো কোনদিনও সম্ভব নয়। যতদিন পর্যন্ত এখানে চিকিৎসা চলবে, শুধুমাত্র ততদিনই হয়তো রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে। এরপরে আমাদের আর কিছুই করার নেই।

  টাকা পয়সার টানা-পোড়েনের জন্য বাড়িতে দুজনের মধ্যে অশান্তি লেগে থাকলেও ইজাজ সাহেব তার স্ত্রীকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। তার কিভাবে যেন বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল,  এই পৃথিবীতে তাকে একা রেখে কোনদিনও তার স্ত্রী পৃথিবী ত্যাগ করতে পারে না ; চিকিৎসা করতে করতে একদিন সে নিশ্চয়ই সেরে উঠবে। আর এই আশায় পড়ে গ্রামে তার যে দু' এক বিঘে জমি ছিল সবই বিক্রি করে দিলেন। 
  কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। যার জন্য তিনি জমি জায়গা সব বিক্রি করে দিলেন - যাকে বাঁচানোর জন্য তিনি নিজে নিঃস্ব হয়ে গেলেন - সেই মহিলাটিই একদিন তাকে এই পৃথিবীতে চরম একাকিত্বের অন্ধকারে ফেলে রেখে কোন এক অজ্ঞাত শান্তির উদ্যানে গিয়ে আশ্রয় নিল। 

ইজাজ সাহেব কেঁদে উঠলেন - শিশুর মত - অবোধ বালকের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।



দ্বাদশ পরিচ্ছেদ




সদ্য মা হারানো রাজু। তার পাশে বসে আছে পিয়া। জিয়াগঞ্জ ফেরিঘাটের পাশে ভাগীরথীর তীরে দুজনে বসে আছে। মাকে হারানোর পর আজকেই প্রথম রাজু কলেজ এসেছে। কিন্তু কলেজে সে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। পিয়ার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে নদীর তীরে। এখানে একটা গাছের ছায়ায় দুজনে বসে আছে। রাজু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নদীর জলের দিকে; ভাগীরথীর জল কলকল রবে ছুটে চলেছে। যেন কারও অদৃশ্য ডাকে সাড়া দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে।
   সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে রাজুর চোখ দুটি ছল ছল করে উঠলো। সে পিয়ার হাত খানা নিজের দুই হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরে ধীরে ধীরে মুখের কাছে নিয়ে এলো। তারপর হাতখানা হঠাৎ কপালের সাথে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। পিয়া সান্ত্বনা দিতে গেল, কিন্তু সেই সান্তনার আঘাতে রাজুর মনের সমস্ত বাঁধ ভেঙে গেল। সে বলতে শুরু করল, -- আমার এই পৃথিবীতে আর কেউ থাকলো না পিয়া...... কেউ থাকলো না। আমি এখন বড়ই একা হয়ে গেলাম।.... আমি এখন কোথায় যাব পিয়া?.... কোথায় গেলে আমার মাকে খুঁজে পাবো?.... আমার মা ছাড়া যে পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই......  আমার মা-ই ছিল আমার জীবনের সবকিছু।... আমি না খেয়ে থাকলে মা আমার কোনদিন ভাত খেত না। আমাকে খাইয়ে দিত, তারপর নিজে খেত।..... কোনদিন বাইরে গিয়ে রাত্রি করে ফেললে, মা আমার ঘুমাতে পারত না, আমাকে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে তারপর নিজে ঘুমাতো।.......  এখন আমাকে আর কে খাইয়ে দেবে পিয়া?....... রাত্রিবেলায় আমার জন্য কে আর অপেক্ষা করে বসে থাকবে?..... রাত্রি করার জন্য আমাকে কে আর বকাঝকা করবে?

  অন্যদিন হলে পিয়া রাজুকে বলতো, -- তোমার পৃথিবীতে কেউ নেই কে বলল - আমি আছি। আমি তোমাকে খাইয়ে দেবো - রাত্রিবেলায় আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবো - তোমাকে ঘুমিয়ে দিয়ে আমি ঘুমাবো - তোমার সমস্ত সেবা যত্ন আমি করব। তুমি চিন্তা করো না রাজু, আমি যতদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকব ততদিন তোমাকে পৃথিবীর সামান্যতম দুঃখও পেতে দেবো না।
  কিন্তু পিয়া রাজুকে তা বলতে পারল না। সে চুপচাপ রাজুর কথাগুলো শুনলো আর তার দুই গাল বেয়ে ২-১ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
   বস্তুত সে রাজুকে তার নিজের ব্যাপারে কিছু বলতে চাইছিল। আর সে কারণেই সে তাকে কলেজ নিয়ে এসেছে। কিন্তু রাজুর কষ্ট দেখে সে কোন মতেই মুখ খুলতে পারছিল না। এবার নিজেকে সামলে নিয়ে রাজুর হাত থেকে নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে রাজুর চোখের জল মুছিয়ে দিল। তারপর রাজুর ডান হাতের আঙ্গুল গুলো দুই হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর ধীরে ধীরে বলল, -- তোমার এখন কেউ নেই ; আর আমারও কেউ নেই রাজু । চলো আমরা দুজনে অন্য কোথাও চলে যাই - অন্য কোন দেশে - তোমার সেই স্বপ্নের দেশে। তুমি একদিন বলেছিলে না, তুমি আমাকে নিয়ে এমন একটি দেশে চলে যেতে চাও যেখানে বাড়িঘর নেই, পরাধীনতার শৃংখল নেই, শুধুই আছে ভালোবাসা আর স্বাধীনতা। আজকে চলো আমরা সেই দেশে চলে যাই। আর এখানে আমরা থাকবো না রাজু - এখানে থাকলে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো - আমি তোমাকে কোনমতেই হারাতে চাই না। চলো আমরা কাল-ই এখান থেকে চলে যাই.... আর একটুও দেরি করবো না।

  রাজু কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে পিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। পিয়া বলে চলল, -- কিছুদিন আগে বিয়ের জন্য বহরমপুর থেকে আমাকে দেখতে এসেছিল। ছেলেটি নাকি রেলের অফিসার, নতুন চাকরি পেয়েছে। ওরা দেখেই আমাকে পছন্দ করে ফেলল। বাবা মাও রাজি হয়ে গেল। এমনকি বিয়ের দিন পর্যন্ত ঠিক করে ফেলল। আমি মাকে বললাম, - আমি এই বিয়ে করব না। মায়ের হাত ধরে পর্যন্ত কাঁদলাম - কিন্তু আমার কথা শুনল না। বললো, - তোর বাবা ওখানে কথা দিয়ে দিয়েছে ; সব কিছুই ঠিক করে ফেলেছে। আর এই বিয়ে কোন মতেই ভেঙে দেওয়া সম্ভব নয়। আমিও বললাম, - আমার জীবন থাকতে আমার পক্ষেও এই বিয়ে করা সম্ভব নয়।
   এবার তুমিই বলো রাজু, আমি এখন কি করবো? যদি আমি বাড়িতে থাকি তাহলে ওরা আমার বিয়ে দিয়ে দেবে। কিন্তু আমি কোনদিনও অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আমি শুধুই তোমার। আমার উপর আর অন্য কারো অধিকার নেই। আমি জীবনে অন্য কারো হতে পারব না। আমি শুধুই তোমার.... শুধুই তোমার রাজু।

  রাজু কোন জবাব দিতে পারল না। মাটির দিকে মুখ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মাত্র কিছুদিন হল সে তার মাকে হারিয়েছে - সে যন্ত্রণা-ই তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। এবার হঠাৎ করে পিয়ার বিয়ের সংবাদ যেন তার সমস্ত চিন্তাশক্তিটাকেই নষ্ট করে ফেলল। সে অপলক দৃষ্টিতে স্থির ভাবে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

  পিয়া রাজুর হাতখানা সামান্য নাড়া দিয়ে বলল, -- তুমি কিচ্ছু চিন্তা করো না রাজু - আমার কিছু গয়না আছে। সেগুলো বিক্রি করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। আমরা সেই টাকা নিয়ে বাইরে কোথাও চলে যাব।...  চলো রাজু কালকেই আমরা এখান থেকে চলে যাই।

রাজু পিয়ার দিকে কিছুক্ষণ উদাস হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর নির্লিপ্তভাবে প্রশ্ন করল, -- কোথায় যাবে?
  পিয়া জবাব দিল, -- বর্ধমানে আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়ি আছে ; সেখানে প্রথমে গিয়ে উঠবো। ওরা আমাকে খুব ভালবাসে। ওদেরকে আমি সবকিছু খুলে বলবো। তাহলে সেখান থেকেই আমাদের কোন একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
  -- কিন্তু পিয়া, ওরা যদি তোমার বাবা-মাকে খবর দিয়ে দেয়?
  -- কোন খবর দেবে না। ওরা আমাকে খুব ভালোবাসে। ওদেরকে সবকিছু খুলে বললে ওরা নিশ্চয়ই আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারবে। তাছাড়া ওদের বাড়ি যাওয়ার আগে তো আমরা বিয়ে করে ফেলব। দু' একদিন হোটেলে কাটিয়ে ওদের বাড়ি যাবো। তাহলে তো ওদের কিছু করার থাকবে না।

  পিয়ার পরিকল্পনা শুনে রাজু কোন উত্তর দিতে পারল না। শুধু তার বুকের মধ্য থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

  পিয়া কিছুক্ষণ রাজুর দিকে তাকিয়ে থেকে আবার প্রশ্ন করল, -- তাহলে কালকে যাবে তো?
   রাজু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর পিয়ার হাতখানা তার মুখের কাছে নিয়ে এসে উল্টো পিঠে একটা চুমু খেয়ে জবাব দিল, -- ঠিক আছে তাই চলো। আমরা বরং এখান থেকে পালিয়েই যাই। এখানে যখন আমাদের কেউই নেই তখন আর এখানে থেকে কোন লাভও নেই। চলো দূরে অন্য কোথাও গিয়ে আমরা প্রাণ ভরে বেঁচে থাকি।...... কালকেই যাবে তো?..... ঠিক আছে..... কখন বাড়ি থেকে বের হতে হবে বল!
  -- ঠিক কলেজের সময়েই বেরোবো। আমি আজ বাড়ি গিয়ে একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে চুপ করে আমার এক বান্ধবীর কাছে দিয়ে আসবো। ও ব্যাগটা কালকে স্টেশন পৌঁছে দেবে। আমি কলেজের নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওকে নিয়ে আজিমগঞ্জ স্টেশন পৌঁছে যাব। তুমি সেখানে অপেক্ষা করে থাকবে। সেখান থেকে আমরা ট্রেন ধরে বর্ধমান পৌঁছে যাব। তারপর যা হওয়ার দেখা যাবে।

  বাড়ি থেকে পালানোর সমস্ত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে তারা সেদিন বাড়ি ফিরে এলো।

  



ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ




আজ পিয়া একটু সকাল সকাল স্নান সেরে নিল। ভেজা চুলগুলো চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভাবান্তর দেখা দিল। এতদিন যা ভাবেনি আজ হঠাৎ করে সেই ভাবনাগুলোই তার মনের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করল। সে নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করল, -- আজ সে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে। কেন?
 - বিয়ে করবে বলে।
 - কিন্তু বাবা-মায়ের অমতে? বাবা-মাকে না জানিয়ে?
 - হ্যাঁ বাবা মায়ের অমতে। কারন সে যাকে চায় তার সঙ্গে বাবা-মা কোনদিনও বিয়ে দেবে না ; তাই সে নিজের সিদ্ধান্তই তাকে বিয়ে করবে। 
 - কেন তাকে বিয়ে করবে? বাবা-মা তো তার জন্য ভালো পাত্র দেখে রেখেছে? তাকে বিয়ে করলেই তো হয়?
 - হ্যাঁ হয়। কিন্তু রাজুকে ছাড়া সে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কথা ভাবতেও পারে না। কারণ সে রাজু কে ভালোবাসে আর রাজু ও তাকে ভালোবাসে।
 - তাহলে কি সে বাবা মাকে ভালোবাসে না? কিংবা বাবা-মা তাকে ভালোবাসে না?
 - হ্যাঁ ভালোবাসে ; প্রচন্ড ভালোবাসে। সে-ও যেমন বাবা মাকে ভালবাসে বাবা মা-ও তাকে জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে।
 - তাহলে সে তার বাবা-মাকে কষ্ট দেবে কেন?
 - না সে তার বাবা-মাকে কষ্ট দিতে চায়না। অন্ততপক্ষে বড় মাপের কোন কষ্ট দিতে চায় না। অসহনীয় কোন কষ্টের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আজ সে তার বাবা মাকে ছোট্ট একটা কষ্ট দিতে চায়।
 - কিসের অসহনীয় কষ্ট? আজকে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেই তো তার বাবা-মা সবথেকে বেশি কষ্ট পাবে।
 - হ্যাঁ কষ্ট পাবে বটে। কিন্তু এ কষ্ট তারা অচিরেই ভুলে যাবে যখন দেখবে তাদের মেয়ে একজনকে পেয়ে কত আনন্দের সঙ্গে এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে। কিন্তু আজকে যদি সে বাবা-মাকে কষ্ট দেওয়ার ভয়ে তাদের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে নেয়, তাহলে সে জীবনে কখনো শান্তি পাবে না ; অশান্তির আগুনে জ্বলতে জ্বলতে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে। তখন তার কষ্ট দেখে তার বাবা-মা শান্তি পাবে তো ? না তারাও তিলে তিলে কষ্ট পেতে থাকবে। নিশ্চয়ই তারা শান্তি পাবে না।
  তারা তো জানে না, তারা কত বড় ভুল করছে। তারা ভাবছে ধন-সম্পদের মাঝে ডুবে থেকেই বুঝি এই পৃথিবীতে শান্তি পাওয়া যায়। হয়তো কেউ কেউ পায়। কিন্তু সবাই তো পায় না।  যারা ভালোবাসার বিনিময়ে নিজের হৃদয়টাকে বিক্রি করে দিয়েছে, টাকা-পয়সা দিয়ে তাদের হৃদয় কোনদিনও কেনা যায় না। আর সেই হৃদয়টাকে চিনতেই তো মানুষ ভুল করে বসে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে যখন তাদের হিসেব মেলেনা, তখন তারা তাদের নির্বোধ বলে গালি দেয়। আর সে-ও বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে সকলের কাছে নির্বোধ হয়ে যাবে - তার বাবা-মার কাছেও। তবুও তাকে পালাতেই হবে - কারণ সে ভালোবাসার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। আজ কোন যুক্তি কিংবা আদর্শ তাকে থামাতে পারবে না। সে যাবেই - যাবে।

  সকাল দশটার সময় খাওয়া-দাওয়া সেরে, মনে মনে বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে, যুক্তি তর্কের মস্ত বড় বোঝা মনের উপর চাপিয়ে নিয়ে পিয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

  পিয়া পীরতলা স্টেশনে এসে দেখল, তার বান্ধবী ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে পিয়াকে আজিমগঞ্জ স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। পিরতলা থেকে তারা ট্রেনে জিয়াগঞ্জ পৌঁছে গেল। সেখান থেকে রিকশা করে জিয়াগঞ্জ ফেরিঘাট। ভাগীরথী নদী পার হয়ে আজিমগঞ্জ স্টেশন - এখানেই রাজুর সঙ্গে  তার দেখা হবে। এখান থেকেই দুজনে ট্রেনে চেপে বর্ধমানের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।

  ট্রেনের এখনো কিছুক্ষণ দেরি আছে। দুই বান্ধবীতে মিলে একবার সমস্ত প্লাটফর্ম টা দেখে নিল - কিন্তু রাজুকে কোথাও দেখা গেল না। ও হয়তো কোনো কারণে একটু দেরি করছে - এখনই হয়তো এসে পড়বে।
   দুজনে প্লাটফর্মের এক কোনায় গিয়ে বসলো। আজ পিয়ার মনের উপর কিসের যেন এক মস্ত বড় পাষাণ ধীরে ধীরে চেপে বসছে। কিসের এত চাপ? সে কিছুই বুঝতে পারছে না। অথচ শত চেষ্টাতেও নিজের মনকে সে হালকা করতে পারছে না। চাপ কমানোর জন্য সে তার বান্ধবীর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের গল্প আরম্ভ করে দিল। ধীরে ধীরে সময় কেটে যাচ্ছে। ট্রেন আসার ঘোষণা হয়ে গেল। ধীরে ধীরে প্লাটফর্ম প্যাসেঞ্জারে পূর্ণ হতে লাগলো। টিকিট কাউন্টারের সামনে লাইন পড়ে গেল। কিন্তু রাজুর দেখা মিলল না।

   পিয়ার দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগলো। কি হলো রাজুর? কেন সে এত দেরি করছে? ওর জন্য শেষ পর্যন্ত ট্রেনটা মিস হয়ে যাবে না তো? ও এসে যদি টিকিট কাটার সময় না পায়? তার থেকে বরং এখনই দুটো টিকিট কেটে নেওয়া ভালো। ও এলে সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে উঠে পড়া যাবে। পিয়া তার বান্ধবীকে বলল, -- আমি এখানে ব্যাগ নিয়ে বসছি। তুই বর্ধমান যাওয়ার দুটো টিকিট কেটে নিয়ে আয় তো!
  তার বান্ধবী একটু ইতস্তত করে জবাব দিল, -- কিন্তু রাজু তো এখন পর্যন্ত এলোনা। ও যদি না আসে?
  -- ও নিশ্চয় আসবে? হয়তো কোন কারনে ওর দেরি হচ্ছে।
  -- কিন্তু দ্যাখ, ও যদি না আসে তাহলে টিকিট দুটোই বাদ হয়ে যাবে।
  -- কিচ্ছু বাদ হবে না। ও আসবেই, আসবে। ওর দেরির জন্য এই ট্রেনটা ফেল করলেও পরের ট্রেনটা তো পাওয়া যাবে?
  -- পরের ট্রেন? সে তো অনেক দেরি!
  -- তোকে অতসব ভাবতে হবে না। তুই আগে টিকিট দুটো কেটে নিয়ে আয়।

   অগত্যা তার বান্ধবী টিকিট কাটতে চলে গেল। কিন্তু পিয়ার মনটা খচখচ করতে শুরু করল। তার মনে আশঙ্কা জাগতে শুরু করল, রাজু এত দেরি করছে কেন? এক্ষুনি তো ট্রেন ঢুকে পড়বে। ট্রেনের সময় অলরেডি হয়েই গেছে। সৌভাগ্যক্রমে আজ ট্রেন একটু লেটে আসবে। তাহলে রাজু কি জানে না ট্রেনের আসল সময়? কিন্তু তা তো নয়। কালকে সে নিজেই তো ট্রেনের সঠিক সময় জেনে গেছে? তাহলে... তাহলে কি সে আসবে না?..... সে কি তাকে ধোঁকা দিল?.... ভাবতেই পিয়ার সমস্ত শরীর শিউরে উঠলো।

 বান্ধবীটি টিকিট কেটে এনে পিয়ার হাতে ধরিয়ে দিল। পিয়া টিকিট দুটি হাতে নিয়ে চঞ্চল হয়ে উঠলো। তার কালো কালো মায়াবী চোখ দুটি শঙ্কিত হরিণীর চঞ্চল চোখের মত মানুষের ভিড়ের মধ্যে একজনের সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু বৃথাই চেষ্টা। তাকে দেখা গেল না। তার বদলে দেখা গেল দুটো লাইনের উপর ভর করে দৈত্যের মতো ছুটে আসছে বর্ধমান গামী ট্রেন। প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকে পড়ল। যাত্রীরা সব ব্যস্ততার সঙ্গে ট্রেন থেকে ওঠানামা শুরু করে দিল। পিয়া একদৃষ্টিতে প্লাটফর্মের প্রবেশ পথের দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু রাজুকে আর দেখতে পেল না।

  ট্রেন ছেড়ে দিল। পিয়া একবার শুধু ট্রেনের দিকে তাকিয়ে দেখল - তারপর মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে সেখানে বসে পড়ল। তার চোখ দুটি ছল ছল করে উঠলো। কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে সে তার বান্ধবীকে বলল, - চল্, বাড়ি চল্। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকবো না।

   দুই বান্ধবীতে মিলে প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে গেল। পায়ে হেঁটে তারা ভাগীরথীর দিকে এগিয়ে চলল। ভাগীরথী নদী পার হয়ে তারা বাড়ি ফিরে যাবে। পিয়ার চোখ দুটি লাল হয়ে গেছে। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছে না। মাঝেমধ্যেই তার ঠোঁট দুটি কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার বান্ধবী তাকে বিভিন্ন ধরনের সান্ত্বনার বাণী শোনাচ্ছে। কিন্তু কোন কথা-ই তার মনকে স্পর্শ করতে পারছে না। পিয়া হেঁটে যাচ্ছে বিধ্বস্ত হয়ে - লক্ষ্যহীন পদক্ষেপে। অনেকক্ষণ পরে তার কম্পিত ঠোঁটের মধ্য থেকে একটি আওয়াজ বেরিয়ে এলো -- ধোকাবাজ।



চতুর্দশ পরিচ্ছেদ





সেদিন রাজু কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে জামা কাপড় গুছিয়ে তার কলেজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। আরো কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস অন্য একটি ব্যাগে গুছিয়ে তার ঘরের এক কোনায় লুকিয়ে রাখল‌ সে কালকেই পিয়ার সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আজ এই বিদায় বেলায় তার মনের মধ্যে কেবলই তার মায়ের মুখের ছবি খানা ভেসে ভেসে উঠছে। মায়ের কাছে বিদায় নেওয়ার জন্য সে তার মায়ের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে সে তার অদৃশ্য মায়ের উদ্দেশ্যে কি সব যেন বলতে শুরু করল। অনেকক্ষণ পরে সে যখন তার মায়ের কবরের মাটি মাথায় ঠেকিয়ে তার মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালো, তখন চারিদিকে প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। দিনের আলোর শেষ চিহ্নটুকু এখনো লুপ্ত হয়ে যায়নি। সেই ঝাপসা আলোকে কবরস্থান থেকে সরু আলি পথের উপর দিয়ে সাবধানে পা ফেলে ফেলে সে বাড়ি ফিরে এলো।

  রাজু বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে দেখলো তার বাবা সামনের বারান্দায় মেঝের উপর কপালে হাত রেখে খালি গায়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে‌। তার বড় দিদি আর মেজ দিদি রান্না ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন বলাবলি করছে। তাকে দেখে মেজদিদি তার কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, -- এখন কি রান্না করবো? ঘরে চাল নেই। কালকেও চাল ছিল না। পাশের বাড়ি থেকে চাল ধার করে এনে রান্না করেছিলাম। বাবাকে বললাম তো কোন উত্তরই দিল না। ঘরের মধ্যে দুটো কচু পড়েছিল সেগুলোই কোন রকমে রান্না করেছি। এখন চাল না থাকলে ভাত হবে কি করে? তুই না হয় একবার বাবাকে চালের কথা বলে দ্যাখ তো!

  রাজু চুপচাপ দিদির কথাগুলো শুনলো। তারপর তার বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলো। দেখল, তার বাবা খালি গায়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে। বারান্দার দেওয়াল থেকে একটি টিপটিপে বৈদ্যুতিক বাল্বের অস্পষ্ট আলো তার শরীরের উপর পড়ছে।
  আজ রাজু তার বাবার শরীরের দিকে তাকিয়ে আর চোখ ফেরাতে পারল না। অদ্ভুত এক বেদনা ধীরে ধীরে তার মনকে গ্রাস করতে শুরু করলো। সে দেখল, তার বাবার শরীর আগের থেকে অনেকখানি শুকিয়ে গেছে। শরীরের ভেতর থেকে হাড় গুলো যেন সারি বেঁধে বাইরে বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পেটখানা যেন আস্ত একটা গর্তে পরিণত হয়েছে। সমস্ত শরীর থেকে কে যেন চর্বি আর মাংসগুলোকে সম্পূর্ণ আলাদা করে কেবল হাড়ের কাঠামোটুকু ফেলে রেখেছে। বাবার শরীরের অবস্থা দেখে রাজুর চোখে জল চলে এলো। সে এর আগে তার বাবাকে এমনভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে  দেখেনি কিংবা দেখার সুযোগ পায়নি। তার মা মারা যাওয়ার পর থেকে তার বাবাকে বাড়িতে দেখাই যেত না। সারাদিন এদিক সেদিক পাগলের মত ঘুরে বেড়াতো। 
  বস্তুত এই বাড়ির প্রধান চালিকাশক্তি ছিলেন রাজুর মা। তিনি সমস্ত পরিবারটিকে যেন কোন এক অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে গুছিয়ে রেখেছিলেন। তিনি চলে যেতেই সমস্ত পরিবারটি একেবারে ছন্নছাড়া হয়ে গেল।

  রাজু তার বাবার অবস্থা দেখে চালের কথা আর কিছু বলতে পারল না। তার দিদির দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, -- দেখ না দিদি, আজকেও না হয় দুটো চাল ধার করে নিয়ে আয়।

  তার দিদি তাকে কি যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার দিদির কথায় কান না দিয়ে রাজু নিচের দিকে মুখ করে হন হন করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

  ঘরের মধ্যে গিয়ে সে দরজা বন্ধ করে তার বিছানার উপর ধপ করে বসে পড়ল। এক দৃষ্টিতে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ দুটি ছল ছল করে উঠলো। আজ বাড়িতে চালটুকুও নেই!.....  রান্না করার কোন কিছুই নেই!..... পরের বাড়ি থেকে চাল চেয়ে নিয়ে এসে ভাত খেতে হচ্ছে!.... কিছু কেনার মত টাকা-পয়সাও নেই!....  থাকলে নিশ্চয়ই তার বাবা বাজার থেকে চাল ডাল কিনে এনে দিতেন ; কোনদিনও নিশ্চিন্তে বাড়িতে পড়ে থাকতে পারতেন না। আর টাকা পয়সা থাকবেই বা কি করে? তার মায়ের চিকিৎসার জন্য যেটুকু জমি জায়গা ছিল সব বিক্রি করতে হয়েছে‌। তাতেও হয়নি - লোকের কাছে কিছু কিছু ধারও করতে হয়েছে।

  এখন সম্পূর্ণ পরিবারটি পুরোপুরি নিঃস্ব..... অসহায়। আর.... আর সে-ই কিনা এই নিঃস্ব ভিখারি পরিবারের মধ্যে বসে বসে এক রাজকন্যাকে বিয়ে করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে?.... সামান্য একবেলা ভাত খাওয়ার জন্য যাদেরকে পরের বাড়িতে চাল ভিক্ষে করতে মেতে হয়, তারা পিয়াকে বাড়ির বউ হিসেবে তুলে এনে তার মুখে কি তুলে দেবে?
  আজ সে আবেগের বশে হয়তো বাড়ি ছেড়ে পিয়াকে নিয়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একদিন না একদিন তো তাকে এই বাড়িতেই পিয়াকে নিয়ে ফিরে আসতে হবে - তখন সে তাকে কি খাওয়াবে? কি পরাবে? 
  পিয়া হয়তো তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আর সেজন্যই পৃথিবীর সমস্ত সুখ সেচ্ছায় ত্যাগ করে দিচ্ছে। কিন্তু পিয়ার কষ্ট কি সে নিজে সহ্য করতে পারবে?
   তার বাবা-মা তার বিয়ে ঠিক করেছেন এক বড়লোক অফিসারের সঙ্গে। তারা তো জানেন কোথায় তাদের মেয়ে সুখে থাকবে, আর কোথায় থাকবে না। সত্যিই তো, তার মধ্যে আর সেই অফিসার ছেলেটির মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সে পিয়াকে  রাজরানী করে রাখতে পারবে - পিয়াকে পৃথিবীর সমস্ত সুখ-ই ঢেলে দিতে পারবে। আর সে তো তাকে কিছুই দিতে পারবে না। না পারবে তাকে দুবেলা ভালোভাবে খেতে দিতে; আর না পারবে দুটো ভালো পোশাক কিনে দিতে।

  ভাবতে ভাবতে রাজুর মাথা চক্কর দিতে শুরু করল। কি করবে এখন সে?.......  পিয়াকে নিয়ে পালাবে, নাকি এই পরিকল্পনা বানচাল করে দেবে। সে কি করবে আর কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। চিন্তাশক্তিটাই যেন তার মাথা থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। একবার বিছানা থেকে উঠে সে তার কলেজের ব্যাগটি হাতে নিল। উদ্দেশ্যহীনভাবে সেটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আবার সেটা যথাস্থানে রেখে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। শুয়ে শুয়ে একবার সে ভাবলো, না হয় পালিয়েই যাবে। তারপর বাকিটা ভাগ্যে যা আছে সেটাই হবে। কারণ সে নিজেও পিয়াকে ছাড়া কিছুতেই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারবে না।
  কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিয়ার বাবা কি এই বিয়ে মেনে নেবেন? যদি না মানেন? তারা পালিয়ে যাওয়ার পরে তিনি যদি পুলিশের কাছে কেস করেন? যদি অপহরণের মামলা করেন? তাহলে তার অসুস্থ বাবাকে পুলিশে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। তার বাবা কি এই অপমান সহ্য করতে পারবেন? এমনিতেই তার মাকে হারিয়ে তার বাবা পাগলের মত হয়ে গেছে ; তার উপরে যদি তার কপালে এই কষ্ট জোটে তাহলে?........ 
  ভাবতেই রাজুর সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে উঠলো। কিন্তু রাজু পরক্ষণেই আবার ভাবলো, পিয়ার বাবা মামলা তো নাও করতে পারেন! বিয়ের পরে পিয়া যদি সবাইকে কিংবা প্রয়োজন হলে পুলিশকে বলে যে সে নিজে থেকেই স্বেচ্ছায় রাজুকে বিয়ে করেছে, তাহলে আর কারো কিছুই করার থাকবে না।
 কিন্তু তাহলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? যদি পিয়ার বাবা পিয়াকে আর কোনদিন তাদের বাড়িতে উঠতে না দেন? কিংবা ভবিষ্যতে কোনো রকমে তার কাছ থেকে ডিভোর্স করিয়ে অন্য কোথাও পিয়ার বিয়ে দিয়ে দেন? তাহলে তো পিয়ার জীবনে মস্ত বড় একটা কলঙ্ক হিসেবে থেকে যাবে আজকের এই ঘটনাটি। তখন তো পিয়া সুখ পাবে না। অথচ তার নিজের তো কোনো ক্ষতিই হবে না। এমনিতেই তার কিছুই নেই...... যা ছিল সবই হারিয়ে গেছে - পড়াশোনা করে বড় হওয়ার স্বপ্ন,  মায়ের আদর, জমি-জায়গা.... সবকিছুই শেষ।
  এখন তার জীবনে শুধুমাত্র একটিই অমূল্য সম্পদ পড়ে রয়েছে - পিয়ার ভালোবাসা। এটি চলে গেলে তার জীবনে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না - সে নিজেও না। কারণ তার জীবন আর পিয়ার ভালোবাসার মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। দুটোই এক। যতক্ষণ পিয়ার ভালোবাসা আছে ততক্ষণ সে নিজেও আছে। আর যেদিন পিয়ার ভালোবাসা তার জীবন থেকে চলে যাবে, সেদিন তার জীবনের প্রদীপ শিখাটিও দপ্ করে নিভে যাবে।
  তাহলে কি সে নিজে বেঁচে থাকার জন্য পিয়াকে নিয়ে পালাবে? নিজেকে সুখী করার জন্য পিয়ার জীবনকে এই অন্ধকার জাহান্নামের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখবে?.... না কখনোই নয় - সে তা কখনোই করবে না। নিজের সংকীর্ণ স্বার্থের জন্য সে তা কখনোই করবে না। পিয়াকে সে সুখী দেখতে চায়। পিয়ার সুখের জন্য সে তার জীবনকে বিসর্জন দিতেও তৈরি। কিন্তু পিয়ার কষ্ট সে কখনোই সহ্য করতে পারবে না - এক মুহূর্তের জন্যও নয়।

  রাজু স্থির করে ফেলল, কাল সে আর পিয়াকে নিয়ে পালাবে না। সে চোখ বুজে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে শুরু করলো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি ছবি - পিয়ার সুখের ছবি। পিয়ার সেই অফিসারের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের টাকা পয়সার কোন অভাব নেই। তারা দুজনে যা ইচ্ছে তাই কিনছে, আর যা ইচ্ছে তাই করছে। দুজনেই এক সুন্দর আনন্দময় জীবন কাটাচ্ছে। 
  রাজু পিয়ার অনেক আনন্দময় দৃশ্য কল্পনা করতে শুরু করলো, আর নিজের মুখে বিড় বিড় করে বলতে লাগলো, -- আমার পিয়া...... তুমি সুখে থেকো পিয়া। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করব, তুমি সুখে থেকো।...... আমি তার কাছে প্রার্থনা করব, তিনি যেন আমার জীবনের সমস্ত সুখ তোমাকে দিয়ে দেন, আর তোমার সমস্ত কষ্ট আমাকে দিয়ে দেন। শুধু তা-ই নয় পিয়া, আমি তার কাছে প্রার্থনা করব, আমার সমস্ত জীবনটা তিনি যেন নিয়ে নেন, আর তার বিনিময়ে তার ভান্ডারের সমস্ত সুখ তোমাকে দিয়ে দেন।...... তুমি সুখে থেকো পিয়া..... সুখে থেকো।..... বলতে বলতে রাজুর দুই চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে শুরু করলো।




পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ




আজ পিয়ার বিয়ে। বাড়ির সামনে মস্ত বড় প্যান্ডেল খাটানো হয়েছে। সুসজ্জিত প্যান্ডেলের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের তৃপ্তিদায়ক সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করানো হচ্ছে। সেই খাবারের সুবাসে সমস্ত পরিবেশটাই যেন পাল্টে গেছে। সবাই খুশি - ভীষণ আনন্দিত। আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে সমস্ত শিশুদের মনের মধ্যে। বড়রাও নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা তামাশা করছে - আনন্দের সময়টুকু পূর্ণভাবে উপভোগ করছে। বিয়ে বাড়ির প্রতিটি প্রাণী আজ আনন্দের জোয়ারে ভেসে চলেছে। শুধুমাত্র যাকে কেন্দ্র করে এই উৎসবের আয়োজন, সেই মেয়েটি ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে আছে। তার চারিদিকে আত্মীয়-স্বজন আর বান্ধবীদের ভিড়। সবাই মিলে হাসি ঠাট্টা করছে আর সেই মেয়েটিকে সাজিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মেয়েটির ঠোঁটের প্রান্তে সামান্যতম হাসির রেখাও দেখা যাচ্ছে না - সে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। তার মনের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, নাকি যন্ত্রণার বিষবাষ্প তার মনকে কুরে কুরে খাচ্ছে, সে কথা বলার মত ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আর একজনের কথা আমি বলতে পারি, তার নাম রাজু।
 
  যদিও সে এই বিয়ে বাড়িতে নিমন্ত্রিত নয় তবুও সে এই বিয়ের ব্যাপারে মনে মনে কতকগুলি হিসেব-নিকেশ নিয়ে ব্যস্ত ছিল :  
  পিয়া আজ তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে - চির জীবনের জন্য। আর কোনদিনও সে ফিরে আসবে না। যে মেয়েটি তার প্রাণ, যে মেয়েটি তার জীবন-মরণ, সেই মেয়েটিই আজ তার জীবন থেকে ছিটকে যাচ্ছে। আজ তো তার কাছে ভীষণ দুঃখের দিন হওয়ার কথা। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আজ তার মনের মধ্যে দুঃখের কোনরকম চিহ্নই নেই। বরং আজ যেন তার নিজেকে অনেকটা হালকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আজ পিয়া মস্ত বড় দুর্দশা থেকে মুক্তি পেয়ে গেল। রাজু মনে মনে ভাবল যে, তার জীবনটা বিষাক্ত, তার পরিবারটিও বিষাক্ত - তাকে এই বিষাক্ত জীবন নিয়েই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হবে।
  তার জীবনের সমস্ত কষ্ট হয়তো সে নিজে সহ্য করে নেবে। কিন্তু পিয়া? সে তো তার সঙ্গে থাকলে তা সহ্য করতে পারত না!..... আজকে পিয়া বেঁচে গেল - সত্যই বেঁচে গেল। এখন সে এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা। এখন তার কষ্ট, তার বেদনা, তার দুর্দশা সম্পূর্ণ তার একার। এই বেদনা আর কোনদিনও পিয়াকে গ্রাস করতে পারবে না। আজ থেকে পিয়া থাকবে সুখে; আনন্দ উল্লাসে তার দিন কেটে যাবে। আর তার আনন্দের কথা শুনে সেও শান্তি পাবে। আর এই শান্তি নিয়েই সে পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে। সুতরাং চিন্তা কিসের?

  চিন্তা কিসের? চিন্তা যে কিসের সেটা রাজু হাড়ে হাড়ে টের পেল বিয়ের মাত্র কয়েকদিন পর থেকেই।

   পিয়ার বিয়ে হয়ে গেল। সে তার স্বামীর সঙ্গে শ্বশুর বাড়ি চলে গেল। প্রথম তুই একদিন রাজু তার পরিবারের দূর্দশার কথা চিন্তা করে কাটিয়ে দিল। সুতরাং পিয়ার চিন্তা খুব বেশি তার মনের মধ্যে স্থান পেল না। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই সে ধীরে ধীরে অনুভব করতে লাগলো, তার জীবন থেকে কি যেন একটা হারিয়ে গেছে - তার বুকের ভেতরটা একেবারেই যেন শূন্য হয়ে গেছে। সেখানে আনন্দ-ফূর্তি, ব্যথা বেদনা, কোন কিছুই যেন আর অবশিষ্ট নেই.... মহাশূন্য.... সমস্ত পৃথিবীটাই যেন মহাশূন্য..... কোথাও কিছুই নেই...... সেই মহাশূন্যের মধ্যে সে একাই দাঁড়িয়ে আছে। সে যেখানেই যাচ্ছে সেখানে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই। বাড়ির মধ্যে বসে থাকা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না - সমস্ত বাড়িটাই যেন মহাশূন্য। বাইরে গিয়েও শান্তি নেই, সেখানেও শূন্যতা। সমস্ত পরিবেশটাই যেন আজ তার কাছে হঠাৎ করে পাল্টে গেল - সমস্ত কিছুই যেন উত্তপ্ত মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। 
 বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতেও তার আর ইচ্ছে করছে না। এখন তার মনের মধ্যে শুধুমাত্র একটিই ছবি ভেসে ভেসে উঠছে। কিন্তু আফসোস সেই ছবির মালিক এখন তার জীবন থেকে হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছে। সে আর সেখান থেকে কোনদিনও ফিরে আসবে না।

 অথচ সে যখন তার পাশে ছিল একদিনের জন্যও সে তার অভাব অনুভব করতে পারেনি। সে তাকে আগলে রেখেছিল - একটা পাখি যেমন ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তার ছানাদের নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে ডানা বিস্তার  করে তাদের আগলে রাখে, ঠিক সেই ভাবেই এতদিন পিয়া তাকে আগলে রেখেছিল। তার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট পিয়া ভাগ করে নিত। তাকে সে তার মিষ্টি কথা দিয়ে সান্ত্বনা দিত। আর তার সংস্পর্শে সেও তার সমস্ত বেদনা মুহূর্তের মধ্যে ভুলে যেত। আর সেজন্যই হয়তো তখন বেদনাকে বেদনা বলে মনে হতো না; সমস্ত বেদনাই সে সহ্য করে নিত।
   কিন্তু আজ?..... আজ তাকে কে সান্ত্বনা দেবে? আজ তো তার পাশে পিয়া নেই। আজ তো সে সম্পূর্ণ একা। আর একা বলেই অন্যজনের অভাবটা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। পিয়া যতদিন তার কাছে ছিল, ততদিন তার অভাব সে বুঝতে পারেনি - একদিনের জন্যও সে ভাবতে পারেনি সে যদি না থাকে তাহলে তার জীবনটা কিরকম দুর্বিষহ হয়ে উঠবে‌। আজ যখন সে সেটাই বুঝতে পারল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

  যতদিন যেতে লাগলো রাজুর জীবনটা ততই দুর্বিষহ হয়ে উঠতে শুরু করল। পিয়ার স্মৃতি তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে তুলল। সে যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই পিয়া..... চতুর্দিকে পিয়া.... এই পৃথিবীটাই যেন পিয়ার রাজত্ব..... কিন্তু এই পিয়া তাকে আর সান্ত্বনা দিচ্ছে না - এই পিয়ার কাছে কোন সুখ নেই, কোন শান্তি নেই। এর কাছে আছে শুধুই নির্যাতন আর অসহ্য যন্ত্রণা। রাজু এই পিয়ার কাছ থেকে মুক্তি পেতে চাইল। সে ভাবলো এই দেশ ছেড়ে যদি অন্য কোথাও চলে যায় তাহলে হয়তো সে শান্তি পাবে; সেখানে আনন্দ ফুর্তিতে হয়তো সে থাকতে পারবে - সেখানে সে পিয়াকে ভুলে যেতে পারবে - পিয়া আর কখনোই তাকে যন্ত্রনা দিতে পারবে না।
  কিন্তু কোথায় যাবে? এমন দেশ কোথায় যেখানে সে শান্তি পাবে? এমন দেশ কোথায় যেখানে গেলে পিয়ার স্মৃতি মুছে যাবে? কোথায় সে দেশ?......  চারিদিকেই সে অন্ধকার দেখতে শুরু করল। এমন অবস্থায় তার মায়ের কথা সব থেকে বেশি করে মনে পড়তে লাগলো। তার শান্তিদায়িনী মায়ের মুখের ছবি খানা বারবার তার মনে ভেসে উঠতে শুরু করল। আজকে যদি তার মা বেঁচে থাকতো, তাহলে আজ সে তার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তো। মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে আদর করতেন, আর সান্তনা দিতেন। মায়ের আদরে সে সমস্ত যন্ত্রণাই ভুলে যেত। কিন্তু হায়! কোথায় তার মা!.... তিনি তো আজ তাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছেন - তাকে তো আর কোনদিনও কাছে পাওয়া যাবে না। তার মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে তার দুই চোখ জলে পূর্ণ হয়ে উঠলো।

  তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাঠ, ঘাট বিশ্ব চরাচর ধীরে ধীরে কালো পর্দার আড়ালে আত্মগোপন করতে শুরু করে দিয়েছে। রাজু খালি পায়ে মাঠের মধ্যে গোরস্থানে তার মায়ের কবরের পাশে এসে দাঁড়ালো। এই সময় সাধারণত মাঠের মধ্যে কিংবা গোরস্থানের আশেপাশে কাউকে দেখা যায় না। অন্ধকার হয়ে গেলে গোরস্থানের আশেপাশে আর কেউ আসে না। এর আগে অন্ধকারে রাজু কখনো এখানে আসেনি। আজ সে এসেছে, কারণ তার মনের মধ্যে আজ ভয় ভীতির কোন চিহ্নই নেই। আজ সে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আজ তো তার সামনে তার মা আছে, তাহলে ভয় কিসের? 

  চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকা ক্লান্তিহীন ভাবে চেঁচিয়ে চলেছে। মাথার উপরে গাছের ডালে নিশাচর পাখিরা পাখা ঝাপটাতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সে দিকে রাজুর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার মায়ের কবরের দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার দুই চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে শুরু করলো। সে তার অদৃশ্য মায়ের উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে কি সব বলতে শুরু করল। অনেকক্ষণ তার মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সে ধীরে ধীরে বাড়ির পথে পা বাড়ালো।

  রাজু ঠিক করে ফেলল, সে এই এলাকা ত্যাগ করে দক্ষিণ ভারতে চলে যাবে। সেখানে তাদের গ্রামের কয়েকজন যুবক কাজ করে। সে তাদের সঙ্গে সেখানে চলে যাবে। সেখানে গিয়ে সে প্রাণ ভরে বেঁচে থাকবে - পিয়া আর কখনোই তাকে যন্ত্রনা দিতে পারবে না। পিয়াকে সে সম্পূর্ণ ভুলে যাবে.... সে তাকে ভুলে যেতে চায়... চিরজীবনের জন্য।
   সুতরাং সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করে একদিন সে তলপি-তলপা গুছিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চেন্নাই চলে গেল।





ষোড়শ পরিচ্ছেদ






এক বছর পার হয়ে গেল। রাজু এখনো বাড়ি ফেরেনি। সেখানে কাজ করে সে যা উপার্জন করে তার কিছু অংশ নিজে খরচ করে, আর বাকি অংশ বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। এবার সে যার মাধ্যমে বাড়িতে টাকা পাঠিয়েছে, তার মাধ্যমে একখানা চিঠি খামের মধ্যে পুরে আঠা দিয়ে সেঁটে তার পুরনো বন্ধু শুভঙ্করের কাছে পাঠিয়েছে। শুভঙ্কর খামের ভেতর থেকে চিঠিখানা বের করে দেখলো - বেশ বড় সাইজের একখানা চিঠি। চিঠি খানা হাতে নিয়ে সে পড়তে শুরু করল :


  প্রিয় বন্ধু শুভঙ্কর,
                          অনেকদিন থেকে তোকে দেখিনি। তোর জন্য মনটা বড়ই খারাপ করে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, কারো ফোন থেকে তোকে ফোন করি। কিন্তু কিভাবে তোকে পাবো? তোদের কারোর ফোন নাম্বার তো আমার জানা নেই। 
   সে যাই হোক, কেমন আছিস? আশা করি ভালো আছিস। আজকে তোকে চিঠি লিখতে বসে অনেক কথাই লিখতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে যেন প্রাণ খুলে তোর সঙ্গে গল্প করি। কিন্তু সে তো আর সম্ভব নয়! আমি হয়তো তোকে লিখে দিচ্ছি; কিন্তু তোর কাছ থেকে তো আমি এই মুহূর্তে কোন উত্তর পাচ্ছি না! এটাই আফশোস!

  জানিস শুভ, এখানে আমার সেরকম কোনো বন্ধু নেই। যে ক'জন আছে তাদেরকে আমি মন খুলে কথা বলতে পারি না। আর সেজন্যই বারবার তোর কথা মনে পড়ে যায়। এখন যদি তুই আমার কাছে থাকতিস তাহলে আমি প্রাণ খুলে তোর সঙ্গে গল্প করতাম; আর আমার মনটাকে হালকা করে ফেলতাম।

   আমার পিয়া কেমন আছে রে? জানতে বড়ই ইচ্ছে করছে। অনেকদিন থেকে ওর কোন খবর পাইনি। প্লিজ, আমাকে একটু জানিয়ে দিস না, ও শ্বশুরবাড়িতে কেমন আছে? যদি ভালো থাকে, তাহলে খুব খুশি হব রে! অনেক শান্তি পাবো।

দ্যাখ, আমি কত বোকা ছিলাম? বাড়িতে যখন ছিলাম, তখন ভেবেছিলাম বাইরে গেলে বুঝে ওকে ভুলে যেতে পারবো। কিন্তু পারলাম কোথায়? এখন তো মনে হচ্ছে আগের থেকে আরও বেশি বেশি ও আমার মনটাকে অধিকার করে নিচ্ছে। বারবার ওর কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। যতই ওকে ভোলার চেষ্টা করছি ততই যেন ওর স্মৃতি আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে।

  তোরা কত ভাগ্যবান বল্ - অন্ততপক্ষে তোরা তো পিয়ার আশে পাশে থাকছিস। ও যে পরিবেশে থাকে তোরাও সেই পরিবেশে থাকিস। ও যে বাতাসে নিঃশ্বাস নেয় তোরাও সে বাতাসেই নিঃশ্বাস নিস। হয়ত ওর শরীরের বাতাস তোদের কেউ ছুঁয়ে যায়। ও যে দৃশ্য দুই চোখ দিয়ে দেখে তোরাও সেই দৃশ্য দেখিস। ও যে পথে চলাচল করে তোরাও সে পথে চলাচল করিস। ওর পায়ের ধুলো হয়তো তোদের পা দুটোকেও স্পর্শ করে যায় - তোদের কি সৌভাগ্য!

    তুই হয়তো এসব কথা পড়ে হাসবি।  আর হাসাই তো স্বাভাবিক - কারণ তোরা তো আর আমার পিয়ার মূল্য বুঝিস না!  ও যে কত মূল্যবান তোরা তা কি করে বুঝবি? ওর মূল্য বুঝি আমি। আর সেজন্যই তো মনে হয়, ও যে বাতাসে নিঃশ্বাস নেয় সে বাতাসের স্পর্শ যদি একবার পেতাম.... ও যে জিনিসটি স্পর্শ করে তার ছোঁয়া যদি একবার পেতাম...... ও যে পথ দিয়ে হেঁটে যায় সেই পথে যদি একবার হেঁটে যেতে পারতাম....... যদি কোন মন্ত্র বলে অদৃশ্য হতে পারতাম, তাহলে তার দরজার সামনে সারাদিন সারারাত দাঁড়িয়ে থাকতাম - প্রাণ ভরে তাকে দেখতাম। তাকে দেখে দেখেই আমার জীবনটা কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু আফশোস, সেই সৌভাগ্য আমার কপালে লেখা নেই।

    জানিস শুভ, এখানে সমুদ্রের ধারে গিয়ে মাঝে মাঝে আমি বসে থাকি। উত্তাল সমুদ্র, সীমাহীন জলরাশি - সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনের ভেতরটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করতে শুরু করে - পিয়ার জন্য মনটা হাহাকার করে ওঠে। মনে হয় যে আমার জীবনে যদি পিয়া থাকতো তাহলে আমার মত সুখী এই পৃথিবীতে আর কেউ হতে পারত না। আমিই হতাম পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে সুখী মানুষ।

    আবার কখনো কখনো মনে হয় আমিই বা ছাই দুঃখী কিসের? আমি তো একদিন পিয়ার ভালোবাসা পেয়েছিলাম। এটাই তো আমার সৌভাগ্য। সৃষ্টিকর্তা আর একটা সৌভাগ্য আমাকে দান করেছেন - তার অনন্তকালের সৃষ্টির মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আমাকে তিনি দয়া করে এমন একটি যুগে, এমন একটি সময়ে পাঠিয়েছেন যেই যুগে, যেই সময়ে তিনি পিয়াকেউ এই পৃথিবীতে পাঠালেন। অর্থাৎ দুজনকে তিনি একই যুগ, একই সময়, একই কালের মধ্যে স্থান দিলেন। শুধু তাই নয়, এই পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে দুজনকে না পাঠিয়ে একটা নির্দিষ্ট স্থানে তিনি আমাদেরকে পাঠালেন। আজ যদি পিয়া আমেরিকায় জন্ম নিতো, তাহলে তাকে আমি কখনোই পেতাম না। পিয়া আমাদের পাশের গ্রামে জন্ম নিয়েছে বলেই আমি তাকে পেয়েছি। এটাই তো আমার পরম সৌভাগ্য। তাহলে আমার দুঃখ কিসের?

    আমি বাস্তবে পিয়াকে পাইনি ঠিকই - কিন্তু আমি ওকে পেয়েছি আমার যন্ত্রণার মধ্যে.... আমি ওকে পেয়েছি আমার হৃদয়ের শুকিয়ে যাওয়া রক্তের মধ্যে.... আমার জীবনের অনন্ত হতাশার মধ্যে আমি ওকে খুঁজে পেয়েছি.... আমার দুটি চোখে ছলকে ওঠা অশ্রুর মাঝে আমি ওকে পেয়েছি। আমি পেয়েছি শুভ - আমার জীবনে আমি ওকে পেয়েছি। আর যেভাবে ওকে পেয়েছি ঠিক সেভাবেই ওকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে এই পৃথিবী থেকে বিদায় হয়ে যেতে চাই।

    কিন্তু তার আগে তোর কাছে একটা জিনিস চাইব। বল্, দিবি? যদি দিস তাহলে তোর কাছে আমি চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকব রে - চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।  এমন বেশি কিছু তোর কাছে আমি চাইবো না। তোর কাছে হয়তো সেটা নিতান্তই মূল্যহীন। কিন্তু আমার কাছে সেটাই অমূল্য সম্পদ। হয়তো তোকে আমার জন্য একটু কষ্ট সহ্য করতে হবে। আর আশা করি তোর এই হতভাগ্য বাল্য বন্ধুর জন্য সেটুকু কষ্ট সহ্য করতে তোর কোন অসুবিধা হবে না।

    আমি যেটা চাই সেটা হচ্ছে এক মুঠো ধুলো। পিয়াদের বাড়ির সামনে যে ফাঁকা জায়গায় পিয়া প্রতিদিন ঘোরাফেরা করে, সেই জায়গা থেকে এক মুঠো ধুলো সংগ্রহ করে যদি আমার কাছে পাঠিয়ে দিস, তাহলে আমি তোর কাছে চিরজীবন ঋণী থাকব - তোর এই ঋণ আমি কোনদিনও শোধ করতে পারব না। আশা করি তোর এই হতভাগ্য বন্ধুর অনুরোধ টুকু তুই রক্ষা করবি।

    তুই হয়তো ভাবছিস এই মাটি নিয়ে আমি কি করব? হ্যাঁ সেটা তো ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই মাটি নিয়ে আমি কি করবো সেটা জানলে তুই হাসবি। হয়তো আমাকে পাগল ভাববি। তা তুই আমাকে পাগল ভাব আর যা খুশি ভাব, তোকে আসল কথা বলতে আমার কোন লজ্জা নেই। তুই এতক্ষণ আমার চিঠি পড়ে নিশ্চয়ই বুঝে গেছিস আমি এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কতখানি একাকিত্বের মধ্যে পড়ে আছি। এখানে আমার কেউ নেই। আমি জানি পিয়াকে আর কোনদিনও আমি পাব না - আর পাবার দুঃসাহসও আমি করি না। আমি যেটা চাই সেটা হলো তার সামান্য স্পর্শ। এই স্পর্শটুকু পেলেই আমি ধন্য হয়ে যাব - আমার একাকীত্ব ঘুচে যাবে। আমি যে ধুলো তোর কাছে  চেয়েছি সেটা তো আর সাধারণ ধুলো নয় - সেই ধুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে আমার পিয়ার স্পর্শ। আমার পিয়া যেই ধুলোর উপর দিয়ে প্রতিদিন হেঁটে যায়.... আমার পিয়া যে ধুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে..... আমার পিয়ার সুগন্ধ মুহূর্তে মুহূর্তে যে ধুলোর উপর ছড়িয়ে পড়ে........  সেই ধুলো কি আর কখনো সাধারণ থাকতে পারে? সেই ধুলো আমার কাছে মূল্যবান সম্পদ। আমি সেই সম্পদ আমার বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চাই।

  প্লিজ শুভ, আমার এই আশাটুকু পূর্ণ করিস। আমি তোর অনুগ্রহের আশায় বসে রইলাম। সঙ্গে একটা চিঠি দিতে ভুলিস না। ভালো থাকিস।

                                     -  ইতি
                                              তোর হতভাগ্য বন্ধু
                                                         রাজু


    চিঠি পড়ে শুভংকরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার মনের মধ্যে রাজুর বিরহ কাতর মুখের একখানা করুন ছবি ভেসে উঠলো। এই সেই রাজু যে স্কুল জীবনে কোন মেয়েকে কথা বলতে ভীষণ লজ্জা পেতো - এই সেই রাজু যে কিনা মেয়েদের কাছ থেকে দূরে দূরে সরে থাকতো - এই সেই রাজু ভীষণ লাজুক, ভীষণ মুখচোরা - কোন মেয়েকে ভালবাসতে ভয় পেতো। সেই রাজুই কিনা আজ চাইছে একটি মেয়ের পায়ের ধুলো!......
   কি এমন আছে মেয়েটির মধ্যে যা দেখে রাজু নিজের অস্তিত্বের কথাই ভুলে গেল? পৃথিবীতে তো আরো অনেকেই ভালোবাসে কিন্তু তারা তো কেউ এরকম পাগলের মত কথা বলে না? পিয়া আজ বিয়ে করে সুখে আছে। বড়লোক স্বামী পেয়ে সে হয়তো রাজুকে ভুলেই গেছে। তাহলে কেন সে পিয়ার কথা মনে রাখবে? কই পিয়া তো রাজুর জন্য এরকম ছটফট করে না? তাহলে কেন সে পিয়ার জন্য ছটফট করবে?
   শুভঙ্করের মনে ধীরে ধীরে আশঙ্কা জন্মাতে শুরু করল - রাজুর মানসিক অবস্থা কি স্থিতিশীল আছে? নাকি দীর্ঘদিন একা একা থেকে এবং পিয়ার কথা চিন্তা করতে করতে সে ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে?
   সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল, সে রাজুকে বোঝাবে। যেভাবেই হোক না কেন সে যেন পিয়াকে ভুলে যায়। কারণ পিয়াকে মনে রেখে তার কোন লাভ নেই। পিয়াকে সে আর কোনদিনও পাবে না - তাকে মনে রেখে সে পাবে শুধুই যন্ত্রনা।

  অনেক ভাবনা চিন্তা করে শুভঙ্কর রাজুর জন্য একখানা মস্ত বড় চিঠি লিখল। যে ছেলেটি রাজুর কাছ থেকে তাকে চিঠি এনে দিয়েছিল তার বাড়ি গিয়ে খামের মধ্যে ঢুকিয়ে সে চিঠিখানা তার হাতে দিয়ে আসলো। বলা বাহুল্য, শুভঙ্কর কিন্তু পিয়ার বাড়ির সামনে থেকে কোনো রকম ধুলো মাটি সংগ্রহ করেনি। ধুলো ছাড়াই কয়েকদিনের মধ্যে শুভঙ্করের উপদেশমূলক চিঠি রাজুর কাছে পৌঁছে গেল।

  কয়েক মাস হয়ে গেল। রাজুর কাছ থেকে আর কোন সংবাদ শুভঙ্কর পেল না। শেষে একদিন খবর পেল, কে একজন সেখান থেকে ফোন করে জানিয়েছে রাজুকে সেখানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে নাকি কোথায় চলে গেছে। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখনও কিন্তু গ্রামে গঞ্জে সেভাবে ফোনের প্রচলন শুরু হয়নি। কারো কারো বাড়িতে ল্যান্ড ফোন থাকলেও হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র মোবাইল ফোন ব্যবহার করত। শুভঙ্করদেরও ফোন ছিলনা। এমত অবস্থায় রাজুর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখাও তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সুতরাং রাজুর নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে সে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেও নিজে থেকে তার প্রকৃত অবস্থা জানতে পারল না।

  কিছুদিন পর সে রাজুর গ্রামের মানুষের কাছ থেকে জানতে পারলো রাজু নাকি আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু কিভাবে সে আত্মহত্যা করেছে তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারল না। কেউ বলল, সে ব্রিজ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে জলে ডুবে মরেছে। কেউ বলল, ট্রেনের লাইনে ঝাঁপ দিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মরেছে। কিন্তু তার মৃতদেহ কোথায় এবং কিভাবে পাওয়া গেল সে খবর আর কেউ দিতে পারল না।

  শুভঙ্করের চোখে জল চলে এলো। রাজুর বিরহ-কাতর মুখখানা আবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সে চোখের জল মুছে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, -- আমাকে ক্ষমা করে দিস বন্ধু। আমি তোর ভালোবাসা চিনতে ভুল করেছিলাম। তুই যে নিজের জীবনের থেকেও একজনকে বেশি ভালোবাসি তা আমি কোনদিনও বিশ্বাস করতে পারিনি। বিশ্বাস করলে অবশ্যই তোকে আমি পিয়ার স্পর্শ করা ধুলো দিয়ে পাঠাতাম। আজ নিজের জীবন দিয়ে তুই আমাকে সেটাই বিশ্বাস করিয়ে দিলি। ধন্য তোর ভালোবাসা...... ধন্য তোর পিয়া...... আমাকে ক্ষমা করিস বন্ধু....... আমাকে ক্ষমা করে দিস।




অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ







বহরমপুর শহর। শহরের এক নিরিবিলি শান্ত রাস্তা। রাস্তার পাশে একটি সুদৃশ্য দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনেটুকু অনুচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। রাস্তা থেকে প্রাচীরের উপর দিয়ে এবং মেন গেটের লোহার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাড়ির সামনে টুকু স্পষ্ট দেখা যায়। বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ তাদের বাহারি রঙের ফুলের পসরা সাজিয়ে বিভিন্ন আকৃতির টবের উপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিয়া ঝাঁঝরি থেকে ফুলের গাছগুলোতে জল দিচ্ছে। এমন সময় বাইরে রাস্তার উপর মোটর বাইকের হর্ন বেজে উঠলো। পিয়া সে দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হাত থেকে জলের ঝাঁঝরিটা নামিয়ে রাখল। বাইক থেকে নেমে স্কুলের ব্যাগ ঘাড়ে একটি বছর চারেকের ফুটফুটে ছেলে তখন 'মা' 'মা' বলে ডাকতে ডাকতে পিয়ার দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে এগিয়ে আসছে। পিয়া তাকে কোলে তুলে নিয়ে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, -- এই যে আমার সোনা, কত সুন্দর স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এলো।

  বাইক থেকে নেমে বছর ছয়-সাতের আর একটি মেয়ে তখন পিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে এসেই পিয়ার কাছে নালিশ জানাতে শুরু করল, -- জানো মা, সেই পাগল টা আজও আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমি স্কুল থেকে বেরোচ্ছিলাম, আর সেই পাগলটা দূর থেকে আমার দিকে কেমন ভাবে তাকাচ্ছিল। আমি দৌড়ে এসে পাপার বাইকে উঠে পড়েছি। পাপাকে বললাম, তো পাপা বলছে, - পাগল-ছাগল মানুষ তাকালে কোন কিছু হবে না। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি মা, এবার থেকে যদি পাগলটা আমার দিকে তাকায় তাহলে আর আমি স্কুলে যাব না।

  পিয়ার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, -- কিগো, কোন পাগল ছাগলে এসে আমার ছেলেমেয়েদের ভয় দেখাবে আর তুমি চুপচাপ থাকবে? তুমি কিছু করতে পারো না? এভাবে যদি ভয় পেয়ে আমার মেয়েটা স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে তুমি কি করবে? তুমি না হয় বিষয়টা একটু স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানাও। এভাবে তো আর চলতে পারে না? প্রতিদিন কোথা থেকে একটা পাগল এসে স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে - আর ছেলে মেয়েরা ভয়ে মরবে?

  পিয়ার স্বামী আশিফ মির্জা রেলের অফিসার। তার ছেলেমেয়েরা স্থানীয় এক নামি স্কুলে পড়াশোনা করে। ছেলেমেয়েদের স্কুল যাতায়াতের জন্য নির্দিষ্ট স্কুল-ভ্যান থাকলেও তিনি নিজেই সময় পেলে কখনো কখনো তাদের স্কুলে দিয়ে আসতেন, আবার নিয়েও আসতেন। আজকেও তিনি ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আসতে স্কুলে গিয়েছিলেন। বাইকটা বাড়ির মধ্যে ঢোকাতে ঢোকাতে নির্লিপ্ত গলায় পিয়ার কথার জবাব দিলেন, -- একটা সামান্য পাগলকে নিয়ে এত ভয়ের কি আছে? ও তো তোমার মেয়ের কোন ক্ষতি করে ফেলবে না! হয়তো আমাদের মেয়েটাকে ওর ভালো লাগে, তাই তাকায়। তাছাড়া ও তো একটা পাগল! কার দিকে কখন তাকায় হয়তো সেটা ও নিজেও জানে না।
   পিয়া তার স্বামীর কথায় খুশি হতে পারল না। সে বলল, -- কিন্তু মেয়েটা তো পাগলটাকে দেখে ভয় পাচ্ছে? ওর মত হয়তো আরো অনেক বাচ্চাই ওকে দেখে ভয় পায়। এসব বাচ্চাদের কথা ভেবে তো সেই পাগল টাকে সেখান থেকে তাড়ানো দরকার!
  -- ঠিক আছে পিয়া ঠিক আছে। আমি কালকেই পাগল টাকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করব। কিন্তু তুমি বাচ্চাদের কথা শুনে তাকে যতটা ভয় পাচ্ছ ততটা ভয়ের কারণ আমি ওর মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না। আমি তো দেখতে পাই সব সময় নিচু দিকে মুখ করে ও চলাফেরা করে। শাটার লাগানো কোন দোকানের বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকে। খিদে পেলে চায়ের দোকানের সামনে অথবা হোটেলের সামনে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের থেকে কখনোই কারো কাছে খেতে চায় না। কারো দয়া হলে ভাত রুটি কিংবা বিস্কুট ওর হাতে ধরিয়ে দেয়। সেগুলো খেয়ে নিয়ে ও চুপচাপ সেখান থেকে চলে যায়। কাউকে কোনদিন ও বিরক্ত করে না। এরকম একটা নিরীহ পাগলের বিরুদ্ধে আমি কিভাবে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করব? আমি তো পাগলটিকে বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি‌। আগে এই এলাকায় ছিল না - সম্ভবত নতুন এসেছে। আবার এখান থেকে হয়তো অন্য কোথাও চলে যাবে। বেচারীকে শুধু শুধু কষ্ট দিয়ে কি করবো বলো? তবে তুমি যখন বলছ, তখন আমি কালকে ওর কাছে নিজে গিয়ে ওকে অন্য কোথাও চলে যেতে বলব, দেখি তাতে কোন কাজ হয় কিনা!

  পরদিন আসিফ স্কুল থেকে বাচ্চাদের নিয়ে এসে পিয়াকে জানালো, -- আমি তোমাকে বলেছিলাম না পিয়া, পাগলটাকে নিয়ে ভয়ের কোন কারণ নেই। আজকে ওর কাছে গিয়ে ছেলেমেয়েদের ভয়ের কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতেই ও নিচু দিকে মুখ করে সেখান থেকে চলে গেল। মুখে কোন কথা বলল না বটে কিন্তু চোখ মুখ দেখে বুঝলাম ও এই ঘটনার জন্য নিজেই খুব অনুতপ্ত। আমার মনে হয় ও আর কোনদিন স্কুলের গেটের সামনে এসে দাঁড়াবে না।

  পিয়া একটু মুচকি হেসে জবাব দিল, -- না এলেই ভালো। কিন্তু আমি পাগল ছাগলকে বিশ্বাস করি না। তুমি হয়তো পাগলদের ভালোবাসো - কিন্তু আমি ওসব একদম পছন্দ করি না। ওরা কখন কি করতে পারে তার কোন গ্যারান্টি নেই। আর তুমিই বা কি করে বুঝলে, ও তোমার সব কথা বুঝে নিয়েছে?

  আসিফ তার স্ত্রী পিয়াকে খুব ভালবাসতো। পিয়ার কথার উত্তরে পিয়ার দিকে রোমান্টিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, রোমান্টিক ভাবে হাসতে হাসতে জবাব দিল, -- বোঝা যায় পিয়া, বোঝা যায়!.... সব কিছুই বোঝা যায়.... আমি যেমন তোমার চোখের ভাষা বুঝতে পারি ঠিক সেভাবেই পাগলের মনের কথাটাও বুঝতে পেরেছি। আমি যে সেন্স দিয়ে তোমার ভালোবাসার আঁচ পেয়েছি সেই সেন্স টা যদি নির্ভুল হয়, তাহলে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, পাগলটাকে কাল থেকে আর স্কুলের গেটের সামনে দেখা যাবে না।

  সত্য সত্যই পাগলটাকে পরদিন থেকে আর স্কুল গেটের সামনে দেখা গেল না। পিয়ার ছেলেমেয়েরা নিশ্চিন্তে স্কুল যাতায়াত করতে শুরু করলো।

  কিছুদিন পর একদিন দুপুরবেলা পিয়া দোতলার ঝুল বারান্দায় জামা কাপড় শুকাতে দিচ্ছিল। হঠাৎ তার নজর গেল রাস্তার ওপারে। সেখানে দাঁড়িয়ে অপরিচিত একটি লোক এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটির পরনে আছে একখানা ময়লা লুঙ্গি - গায়ে জড়ানো বিশাল মাপের শতচ্ছিন্ন একখানা ময়লা চাদর - মুখ ভর্তি বড় বড় দাড়ি - আর মাথা ভর্তি বড় বড় চুল । চুল দাড়িতে জটা না থাকলেও সেখানে কখনো চিরুনির স্পর্শ পড়েছে কিনা সন্দেহ। একটি ছোট সাইজের পুঁটলি বুকের মধ্যে চেপে ধরে, লোকটি তার লাল লাল দুটি চোখ দিয়ে আত্মহারা হয়ে পিয়াকে দেখছে।
  লোকটির লাল চোখ দুটিতে পিয়ার দৃষ্টিপড়তেই লোকটি মুখ নিচু করে সেখান থেকে ধীরে ধীরে চলে গেল। পিয়ার ভেতরটা ছ্যাত্ করে উঠলো। কে এই মানুষটি? কেন তার দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছিল?
  পিয়া কোন কিছুই বুঝতে পারল না। কিন্তু এক অজানা আতঙ্ক ধীরে ধীরে তার মনকে গ্রাস করতে শুরু করল। সেই দুটি লাল চোখ, এক মুহূর্তের জন্য পিয়ার দুটি চোখ যার উপর পড়েছিল, তার সমস্ত হৃদয়কে সন্ত্রস্ত করে তুলল। তার কেবলই মনে হতে লাগলো, কোথায় যেন এই চোখ দুটি সে দেখেছে। কিন্তু কোথায়? কিছুতেই তার মনে পড়ছে না।
  সেদিন সারাদিন সেই লোকটির দৃষ্টি তার মনকে আচ্ছন্ন করে রাখল। এক মুহূর্তের জন্যও লোকটির কথা সে ভুলতে পারল না।

  সন্ধ্যাবেলা আসিফ বাড়ি ফিরে এলে পিয়া দুপুরের ঘটনাটা তাকে খুলে বললো। সমস্ত ঘটনা শুনে এবং পিয়ার আতঙ্ক দেখে আসিফ হো হো করে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে আসিফ পিয়াকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, -- ও কেউ না। সেই পাগলটা। এতদিন তোমার মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। এখন দেখছি তোমার প্রেমে পড়ে গেছে।

  পিয়া এক ঝটকায় নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে বলল, -- ইয়ার্কি ছাড়ো তো! সব সময় ইয়ার্কি। এত বড় একটা সিরিয়াস ঘটনা, আর তোমার কাছে কিছুই না?
  -- কিসের সিরিয়াস, সোনা? এতো একটা সামান্য ঘটনা। প্রতিদিন কত শত মানুষ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। তারা কি এই বাড়ির দিকে কেউ তাকায় না? হয়তো পাগল টাও রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল; বাড়িটা ওর ভালো লেগেছিল - তাই দেখছিল। দেখতে দেখতে হয়তো ওর তোমার দিকে চোখ চলে গেছে - আর সেই মুহূর্তেই তুমি ওকে দেখে ফেলেছ। এই তো ব্যাপার।
  -- হ্যাঁ এইতো ব্যাপার! তোমার কাছে তো এটা একটা সামান্য ব্যাপার। কিন্তু ব্যাপারটা যতই হালকাভাবে নাও না কেন, ব্যাপারটা আমার কাছে মোটেও সুবিধের নয়। ওই পাগলটার তাকানোর ভঙ্গিটা আমাকে মোটেও ভালো লাগেনি। ওর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে। ও নিশ্চয় আমার মেয়েটার পেছনে লেগেছে। কি জানি, কখন কি ক্ষতি করে বসে থাকবে? আজকে আমার কথাগুলো তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? কিন্তু কোনদিন বাই চান্স কিছু ঘটে গেলে সেদিন বুঝবে।  

  পিয়ার কথার জবাবে আসিফ মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল, -- হায়রে কপাল! পাগলদেরও পৃথিবীতে নিজের মত বেঁচে থাকার অধিকার নেই! কথায় কথায় তাদের উপর সন্দেহ! পৃথিবীতে পাগল হওয়াটাও ভুল।

  দুইদিন পর দুপুরবেলা আবার পাগল টিকে রাস্তার উপর দেখা গেল। দোতলার বারান্দার গ্রিল গুলো পরিষ্কার করতে করতে পিয়া দেখল, লোকটি মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এক সময় রাস্তার ওপারে একেবারে তাদের বাড়ির মেন গেটের সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। চোরের মত সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশের অবস্থাটা একবার সে দেখে নিল। তারপর ধীরে ধীরে গেটের ফাঁক দিয়ে ভেতরের দিকে তাকাতে শুরু করল। দোতলার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে পিয়ার চোখে তার চোখ পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে গেল। পিয়া আজ লক্ষ্য করল, লোকটির মুখের বেশিরভাগ অংশে কালো কালির ছোপ ছোপ দাগ রয়েছে। হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই সে মুখে কালি ঝুলি মেখে এসেছে।

  লোকটির সন্দেহজনক ঘোরাফেরা পিয়াকে অস্থির করে তুলল। তার থেকেও বেশি তাকে সন্ত্রস্ত করে তুলল লোকটির দৃষ্টি। কি এমন আছে ওই দুটি চোখে, যা দেখে সে কাঁপতে শুরু করে দিচ্ছে? কি এমন শক্তি লুকিয়ে আছে ওই দৃষ্টিতে, যা তার রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে? কে ওই লোকটি? কি তার পরিচয়? সে কি সত্যি পাগল, নাকি কোন গুপ্তচর? নাকি কোন অপহরণকারী? কে সে? কোথাও কি তাকে সে দেখেছে? হয়তো দেখেনি। তাহলে তার চোখ দুটি তার এত চেনা চেনা মনে হচ্ছে কেন? চোখ দুটি বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে কেন? চোখ দুটি তাকে এত চঞ্চল করে তুলছে কেন? পিয়ার মাথায় কোন কিছুই ঢুকছে না। সারাদিন অস্থিরভাবে বাড়ির মধ্যে ঘোরাফেরা করে সে কাটিয়ে দিল। তার মনের ভেতর থেকে যেন সমস্ত শান্তি কোথায় হারিয়ে গেছে।

  রাত্রিবেলা পিয়া আবার তার স্বামীর সামনে পাগলটির কথা বলতে গেল। কিন্তু আসিফ সমস্ত বিষয়টি হেসে হেসে উড়িয়ে দিল।

  কিন্তু এর কিছুদিন পর থেকে পাগলটির উপর আসিফেরও সন্দেহ জন্মাতে শুরু করে দিল। সে এখন প্রতিদিন তার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে খবর পেতে শুরু করলো যে লোকটি প্রতিদিন দুপুরবেলা একবার করে এই রাস্তা দিয়ে যায় আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এই বাড়িটার দিকে তাকায়। পাগলটির ভয়ে ছেলেমেয়েরা আর কেউ বাইরে বের হতে সাহস পায় না।

  সেদিন ছুটির দিন। দুপুর বেলা টেবিলের সামনে চেয়ারের উপর বসে আশিফ অফিসের কিছু কাগজপত্র দেখছিল। এমন সময় পিয়া প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে ঘরে ঢুকলো। আশিফের হাতখানা ধরে টানতে টানতে বলল, -- তাড়াতাড়ি উপরে চলো। সেই পাগলটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে।

  উপরের ঘরে এসে পিয়া জানালার ফাঁক দিয়ে এমন ভাবে উঁকি মারল যাতে বাইরে থেকে তাকে কেউ দেখতে না পায়। তারপর আশিফকে সেই ফাঁক দিয়ে দেখার জন্য ইশারা করল। আশিফ সেই জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো, পাগলটি রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে এই দোতলার দিকেই তাকিয়ে আছে আর বিড়বিড় করে নিজে নিজে কি যেন সব বলছে‌। দোতালায় কাউকে দেখতে না পেয়ে সে একতলার দিকে তাকিয়ে কি যেন খোঁজ করতে শুরু করল। সেখানেও কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার সে দোতলার দিকে তাকাতে শুরু করল।

  এবার আসিফ ভীষণভাবে রেগে গেল। বিশেষ করে এই পাগলটির কালি মাখা মুখ তার সহ্য হলো না। আগে যখন সে তাকে দেখতে  পেত তখন তার মুখে এরকম কালি ঝুলির কোন চিহ্নই থাকত না। জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে আশিফ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে সে বলতে লাগলো, -- শুয়োরের বাচ্চা, কালি মেখে এখানে ভয় দেখাতে এসেছে? দাঁড়া আজ তোকে দেখাচ্ছি মজা।

  বাড়ি থেকে একখানা ছোট সাইজের রড হাতে নিয়ে  রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে সে বাইরে বেরিয়ে এলো। রড খানা পাগলটির মুখের সামনে ঘোরাতে ঘোরাতে চিৎকার করে বলতে লাগলো, -- এই  জানোয়ারের বাচ্চা, আমার বাড়ির সামনে কেন ঘোরাঘুরি করিস? জানিস আমি তোর কি করতে পারি? আমার ইচ্ছা হয় এখানেই তোকে পিটিয়ে মেরে ফেলি। কিন্তু আমি তা করবো না। এরপর থেকে তোকে যদি আমি এই এলাকার মধ্যে দেখি তাহলে তোর আমি কি অবস্থা করব দেখিস।

  লোকটি অবাক হয়ে বিস্ফারিত চোখে আসিফের দিকে তাকিয়ে রইল - মুখে একটি কথাও উচ্চারণ করল না। আসিফ কিছুটা শান্ত হলে লোকটি আবার তার বাড়ির দোতলার দিকে তাকিয়ে দেখলো। সেখানে তখন পিয়া তার দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। লোকটি পিয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিচে দিকে মুখ করে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে লোকটি আবার থমকে দাঁড়ালো। পেছন ফিরে আবার দোতলার দিকে তাকিয়ে দেখলো। তারপর সেখান থেকে চলে গেল।

  এরপর থেকে পাগলটিকে আর কখনো সেই এলাকায় দেখা যায়নি।





ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ





রানাঘাট জংশন। আশিফ মীর্জা সপরিবারে স্টেশনে প্রবেশ করলো। সে সম্প্রতি রানাঘাটে পোস্টিং পেয়েছে। সপরিবারে এখানে কিছুদিন থাকার পর আজ তারা সবাই মিলে ছুটিতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।

  প্লাটফর্মের একদিকে যেতে যেতে হঠাৎ পিয়া থমকে দাঁড়ালো। প্ল্যাটফর্মের এক কোনার দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে তার স্বামীকে প্রশ্ন করল, -- ওই দেখো, সেই পাগলটি না?

  আশিফ তার স্ত্রীর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলো, একটি লোক চাদর মুড়ি দিয়ে একটি পুঁটুলির উপর মাথা রেখে তাদের দিকে পেছন ফিরে শুয়ে আছে। লোকটির মুখটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু লোকটির দেহের আকৃতি, চাদরের রং এবং মাথার চুল অনেকটাই সেই পাগলটির সঙ্গে মিলে যায়। আসিফ লোকটিকে ভালোভাবে দেখে নিয়ে জবাব দিল, -- হলেও হতে পারে। অন্তত না হওয়ার কোন কারণ নেই।

  পিয়া আসিফকে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় পিছন দিক থেকে আওয়াজ ভেসে এলো, -- আরে আসিফ তুমি? এখানে কি করছ? এ যে দেখছি বৌমাও সঙ্গে আছে।

  আশিফ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, তার পরিচিত এক বয়োজ্যেষ্ঠ রেলের অফিসার সস্ত্রীক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

  রানাঘাট আসার কারণ জানিয়ে আশিফ অফিসারটির সঙ্গে গল্প শুরু করে দিল। তার ছোট ছেলেটি তখন হাতে একটা রবারের ছোট বল নিয়ে লোফালুফি করছিল। অফিসার লোকটি ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে খুব প্রশংসা করলেন। তারপর আবার আশিফের সঙ্গে গল্প শুরু করে দিলেন।

  স্টেশনের মাইকে তখন সুমিষ্ট মহিলা কন্ঠ ঘোষণা করে চলেছে, -- অনুগ্রহ করে শুনবেন, এক নম্বর প্লাটফর্ম দিয়ে থ্রু ট্রেন যাবে। অনুগ্রহ করে নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়ান। 

  এক নম্বর প্লাটফর্মে লাইনের পাশে যেসব যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকে একটু সরে দাঁড়ালেন। পিয়া নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়েছিল। সে তখন তার সঙ্গীদের সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দুরন্ত গতিতে বাঁশি বাজিয়ে প্লাটফর্ম কাঁপাতে কাঁপাতে তখন ছুটে আসছে এক্সপ্রেস ট্রেন। এমন সময় প্ল্যাটফর্মের যাত্রীরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো, এই গেল গেল....... এই ধরো ধরো.....
    পিয়া পিছন ফিরে রেললাইনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, তার ছোট ছেলেটি কখন তার পাশ থেকে সরে গিয়ে রবারের বলের পেছন পেছন ছুটছে। বলটি গড়িয়ে গড়িয়ে রেল লাইনে গিয়ে পড়ল। ছেলেটিও বলটি ধরতে গিয়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে গেল। কয়েকজন যাত্রী ছেলেটিকে ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু ততক্ষনে ট্রেন একেবারে কাছে চলে এসেছে। 
  পিয়া পাগলের মত লাইনের উপর ঝাপিয়ে পড়তে গেল; কিন্তু অন্যান্য যাত্রীরা তাকে ধরে ফেলল। এমন সময় কে যেন একজন লাইনের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে তার উপর দিয়ে ট্রেন চলে গেল। সমস্ত প্ল্যাটফর্মটা 'হায়' 'হায়' করে উঠলো। পিয়া 'ওরে আমার কি হলো রে' - বলে চিৎকার করতে করতে মেঝেতে লুকিয়ে পড়ল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে গেল।

  কিছুক্ষণ পর ট্রেনের শেষ কামরাটি প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে গেল। সমস্ত কৌতুহলী দর্শক লাইনের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সবাই দেখতে পেল সেই ছোট বাচ্চাটি লাইনের ওপারে বসে বসে কান্না করছে। তার বিশেষ কিছু ক্ষতি না হলেও হাত পা ছড়ে গিয়ে সেখান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। কিন্তু যে লোকটি তাকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার সমস্ত শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তার মাথাটি শরীর থেকে আলাদা হয়ে একদিকে পড়ে আছে।

  আসিফ তার ছেলেকে জীবিত দেখে লাইনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বুকের মধ্যে চেপে ধরল। পিয়াও তার পেছন পেছন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সে আসিফের কোল থেকে ছেলেটিকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরল। এবার লাইনের উপর পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহটির দিকে তাকালো। দেহ থেকে কয়েক হাত দূরে মাথাটি পড়েছিল। সেদিকে তাকিয়ে পিয়া চিৎকার করে সেখানে ধপ করে বসে পড়ল। মাথাটি আকাশের দিকে মুখ করে পড়ে আছে। দুটি চোখ এখনো খোলা রয়েছে - যেন কারো দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই মুখটি দেখে পিয়ার আর চিনতে অসুবিধা হয়নি - এই সেই পাগল..... যাকে এতদিন সে ভয় পেয়ে এসেছে...... সেই ভয়ার্ত চোখ দুটি আজও সে দেখতে পেল..... সেই চোখ দুটি আজকে তাকে যেন বলছে - এতদিন তুমি আমাকে ঘৃণা করে এসেছ - ভয় পেয়েছো - কিন্তু আজকে আমিই তোমার ছেলেকে বাঁচালাম।

  প্রিয়ার পাশ থেকে তখন একটি লোকের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, -- আহারে, মানুষটি একটি অপরিচিত ছেলেকে বাঁচাতে এসে নিজেই শেষ হয়ে গেল.... ছেলেটিকে লাইন থেকে সরিয়ে দিল.... কিন্তু নিজে আর বেরোতে পারল না।


সেদিন আসিফদের আর বাড়ি ফেরা হলো না। ডাক্তার দেখিয়ে ছেলেকে সুস্থ করার জন্য সেদিন তারা সেখানেই থেকে গেল।

  পরদিন দুপুরবেলা পিয়া কি একটা কাজে ব্যস্ত ছিল। আশিফ বাইরে থেকে ব্যাগের মধ্যে কি যেন একটা নিয়ে এসে পিয়ার সামনে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, -- তোমার কাজ শেষ হলো?
   আসিফের দিকে না তাকিয়েই পিয়া জবাব দিল,  --না হয়নি, বাবুর জামাকাপড় গুলো পরিষ্কার করতে হবে।

   আসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে পিয়াকে বলল, -- একবার এদিকে এসো তো - আমি এক অদ্ভুত জিনিস নিয়ে এসেছি। কালকে যে পাগলটি আমার ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছে তার পুঁটুলির মধ্য থেকে এটা পাওয়া গেছে। 
  পিয়া কাজ করতে করতে জিজ্ঞেস করল, -- কি জিনিস পাওয়া গেছে?
  -- সেটা দেখানোর জন্যই তোমাকে ডাকছি।
  -- ঠিক আছে তুমি একটু ওয়েট করো। আমি কাজটি সেরে আসছি।

  এমন সময় আসিফের মোবাইল বেজে উঠলো। মোবাইলে কথা বলে সে পিয়াকে বলল, -- আমার ইমারজেন্সি একটা দরকার পড়ে গেল। আমি এক্ষুনি আসছি।

  সমস্ত কাজ গুছিয়ে পিয়া ঘরে ঢুকে দেখলো টেবিলের উপর সাদামত আধ ময়লা ছোট একটা কাপড় পড়ে আছে। পিয়া সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল, ভাঁজ করা একটা রুমাল। রুমালের ভাঁজটা খোলা মাত্রই পিয়ার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো; সমস্ত শরীরটা থর থর করে কেঁপে উঠল। 

  সাদা রুমালের মধ্যে লাল সুতোর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা 'লাভ' চিহ্ন - আর তার মধ্যে লেখা আছে 'রাজা' 
   তার আর চিনতে বাকি থাকল না এই সেই রুমাল যেটি একদিন সে পরম যত্নে, হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসা নীংড়ে তিলে তিলে একটি একটি করে সুতো গেঁথে তৈরি করেছিল..... রাত্রি জেগে লুকিয়ে লুকিয়ে তার সমস্ত আবেগ আর ভালোবাসা দিয়ে একটি নাম ফুটিয়ে তুলেছিল - "রাজা"।

  রুমালটি বুকের সঙ্গে চেপে ধরে সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তার কম্পিত ঠোঁটের প্রান্ত থেকে অস্পষ্ট কয়েকটি আওয়াজ বেরিয়ে এলো...... শেষে প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো - "রাজা"............ তারপর সে ধপ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।



                                        সমাপ্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.